এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। আগামী ১১ই মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ডাকসু নির্বাচনের জন্য এখনো ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত হয়নি বলে দাবি ছাত্রলীগ ছাড়া অন্যান্য ছাত্র সংগঠন ও কোটা আন্দোলনের নেতাদের। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে- ‘ক্যাম্পাসে সহাবস্থান আছে। কোথাও যদি কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটে, তবে সকলের সহযোগিতায় সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।’
ডাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতিপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলোর যতগুলো সভা হয়েছে সবগুলোতেই প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল সহাবস্থান নিশ্চিত করা। ছাত্রদলসহ বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে এখনো অবাধে ক্লাস-পরীক্ষা দিতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে ছাত্রলীগের দাবি ক্যাম্পাসে সহাবস্থান আছে। সবাই স্বাভাবিকভাবে ক্যাম্পাসে চলাফেরা করছে। ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
রোববার দুপুরে ডাকসু নির্বাচনের জন্য গঠিত আচরণবিধি প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা। এসময় তারা পাঁচটি দাবি করেন। দাবিসমূহের মধ্যে রয়েছে- ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত করে সকল শিক্ষার্থী যাতে নির্বিঘ্নে ক্যাম্পাসে চলাফেরা করতে পারে; কোনো রাজনৈতিক সংগঠন যাতে ক্যাম্পাসে সকলের সহাবস্থানে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি না করতে পারে; সম্প্রতি যারা শিক্ষক; শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্ন ভাবে হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং হলে আবাসিক শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো প্রকারের নির্যাতন বা ভয়ভীতির সম্মুখীন না হয় তা নিশ্চিত করা এবং নির্বাচন সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে তফসিল ঘোষণার আগেই ক্যাম্পাসে নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা।
এদিকে ডাকসু নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক নিজেদের তৎপরতা বাড়িয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলো। মধুর ক্যান্টিনে নিয়মিত সময় দিচ্ছে ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসে শোডাউন করছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। বাম ধারার ছাত্র সংগঠনগুলো নিয়মিত মধুর ক্যান্টিনে হাজির থাকছেন। বারবার নিজেরা বসছেন ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিলে তার করণীয় নিয়ে। বিভিন্ন ইস্যুতে ক্যাম্পাসে মিছিল মিটিংও অব্যাহত রাখছেন তারা। অন্যদিকে ছাত্রলীগ ও বামসমর্থিত ছাত্র সংগঠনের যখন দৃশ্যমান তৎপরতা তখন অনেকটা ভেতরে থেকে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে ছাত্রদল ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফরম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। মধুর ক্যান্টিন তো নয়ই, ক্যাম্পাসের আশেপাশে ঘেঁষতে পারছে না ছাত্রদল। মাঝে মাঝে টিএসসিকেন্দ্রিক দেখা মেলে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের। স্বল্প সময় থেকে অবস্থান পরিবর্তন করছে তারা। এ ছাড়াও সংগঠনটির নেতাকর্মীরা নির্বিঘ্নে ক্লাস-পরীক্ষায়ও অংশ নিতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। একই অবস্থা কোটা আন্দোলনের নেতাদের। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে আসলেও তাড়াতাড়ি সরতে হচ্ছে। টিএসসিকেন্দ্রিক তাদের তৎপরতা বেশি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমিতে কোটা আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুরুসহ কয়েকজন নেতাকে অবরুদ্ধ করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। যদিও ছাত্রলীগ সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নেই বলে অভিযোগ করেন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। আমরা বার বার বলার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে যেতে পারছেন না। তারা বাধা পাচ্ছেন। নির্বাচনের জন্য প্রধান যে শর্ত সহাবস্থান, সেটি নিশ্চিত না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে না।’
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচনের জন্য অন্যতম যে বিষয় সহাবস্থান সেটি নিশ্চিত হয়নি এখনো। আমরা এখনো ক্যাম্পাসে স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছি না। গত বৃহস্পতিবারও আমাদের কয়েকজন নেতাকর্মীকে বাংলা একাডেমিতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। আমরা বিষয়টি নিয়ে রোববারও আচরণবিধি প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ ম্যামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে- কেউ বাধা দেবে না সকলেই নির্বিঘ্নে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেয়া ও চলাফেরা করতে পারবে।’
প্রগতিশীল ছাত্রজোটের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে নির্বাচন করার মতো এখনো কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি। ক্যাম্পাসসহ হলগুলোতে এখনো ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের আধিপত্য ও দখলদারিত্ব চলছে। আমরা বারবার বলার পরও প্রশাসন সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করেনি।’
সহাবস্থানের বিষয়ে ভিন্ন মত দিয়েছেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিৎ চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে সহাবস্থান আছে। সকলেই সমান সুযোগ পাচ্ছে। ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। তিনি বলেন, কোনো আদুভাইকে তো আর আমরা ক্যাম্পাসে নিয়ে আসতে পারি না। আর কোটা আন্দোলনকারীরা তো হচ্ছে জঙ্গি। যারা আমাদের ভিসি স্যারের বাসায় সন্ত্রাস করেছে। তাদের যদি সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিহত করে তাহলে তো আমাদের আর কিছু করার নেই। তিনি বলেন, সহাবস্থানের বিষয়ে ছাত্রলীগ বাধা দিচ্ছে বলে যে অভিযোগ এসেছে তার ভিত্তি নেই।’
সহাবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে সহাবস্থান আছে। সকল শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। কোথায়ও বাধা দেয়ার অভিযোগ আমরা পায়নি। তবে কেউ যদি বাধা পায় তাহলে তারা যেন আমাদের অবহিত করে।’
উল্লেখ্য, দীর্ঘ ২৮ বছর পর আগামী ১১ই মার্চ জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির কারখানা বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। গত ২৩শে জানুয়ারি নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। ২০১২ সালে ২৫ সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীর রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছর ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দেয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় আদালত। এরপর রায়ের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আপিল করলে রায় স্থগিত ও চূড়ান্তভাবে প্রধান বিচারপতি ডাকসু নির্বাচনের নির্দেশ দিলে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বিভিন্ন সময় ডাকসু নির্বাচনের জন্য সাধারণ শিক্ষার্থী ও বামসমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলো আন্দোলন করলেও আলোর মুখ দেখেনি। তবে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়ালিদ আশরাফ নামে সান্ধ্য কোর্সের এক শিক্ষার্থীর আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। কর্তৃপক্ষও ডাকসু নির্বাচনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ হাতে নেয়।
ইতিমধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দুই দফায় পরিবেশ পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছেন ভিসি। নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রধান নির্বাচনী রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ছয় রিটার্নিং কর্মকর্তাকে। গঠন করা হয়েছে ১৫ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ ও সাত সদস্যের আচরণবিধি প্রণয়ন কমিটি। আচরণবিধি প্রণয়ন কমিটি খসড়া একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করেছে। ১৪টি ধারায় বিভক্ত আচরণবিধিটি গত শুক্রবার ছাত্র সংগঠনগুলোর কাছে পাঠানোও হয়, যাতে আপত্তির বিষয়ে জানানো হয়।