এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র আশরাফুল। লেখাপড়া করে উচ্চ শিক্ষিত হবেন। পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করবেন। এরকম নানা ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিধিবাম। একটি সড়ক দুর্ঘটনা তার পিতাকে উপার্জনে অক্ষম করে তুলে। ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে লেখাপড়ায় ভাটা পড়ে।
আশরাফুল পরিবারের পাশে দাঁড়াতে খুঁজতে থাকেন আয়ের উৎস। অনেক চেষ্টা করেও কোথাও চাকরি পাননি। হতাশ হয়ে পড়েন। পুরো নাম আশরাফুল ইসলাম। ২০১৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন রংপুর সরকারি কলেজ থেকে। এরপর ভর্তি হন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে যাই হোক। পড়ালেখা বন্ধ। চাকরিও পাচ্ছেন না।
হঠাৎ তার ভাবনায় যোগ হয় অ্যাপভিত্তিক বাইক চালানোর বিষয়টি। সেই ভাবনা থেকেই নানার সহযোগিতায় কেনেন একটি পুরাতন মোটরসাইকেল। শুরু করেন অ্যাপভিত্তিক বাইক চালানো। বর্তমানে লেখাপড়া বন্ধ থাকলেও পরিবারকে পাঠাতে পারছেন অর্থ। আশরাফুল বলেন, আমার লেখাপড়া বন্ধ হলেও ছোট বোনের লেখাপড়া চলছে, এতেই আমি খুশি। আর আমারও ইচ্ছা, খুব তাড়াতাড়ি আবার লেখাপড়ায় ফিরে যাবো। তিনি বলেন, প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বাইক চালাই। আয় মাসে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। কোনো মাসে ২০ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যায়। বাড়িতে পাঠান ১০ হাজার টাকা। শুধু আশরাফুল নয়।
এমন লাখো মানুষের জীবিকার মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই অ্যাপভিত্তিক বাইক সেবা। বিআরটিএ’র সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় নিবন্ধিত বাইকের সংখ্যা ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪৯০টি। এরমধ্যে গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রাজধানীতে মোট নিবন্ধিত মোটর বাইকের সংখ্যা প্রায় ৭৩ হাজার। এর বেশিরভাগই অ্যাপভিত্তিক সেবা প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রার্ড বাইক। যুক্তরাষ্ট্রের রাইড শেয়ারিং অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘উবার’-এর মোটরের প্রায় এক লাখ চালক রাজধানীতে মোটর চালিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকায় আরেকটি জনপ্রিয় বাইক রাইডিং পাঠাও’র আছে প্রায় দেড় লক্ষাধিক রাইডার। এ ছাড়াও রাজধানীতে সহজ ডট কম, স্যাম, ওভাই, ওবোন ইত্যাদির আওতায় আছে আরো প্রায় ৫০ হাজার রেজিস্ট্রার্ড বাইক। এই হিসাবে রাজধানীতে মোট রেজিস্ট্রার্ড বাইকারের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। তবে এই রাইডারদের অনেকেই একসঙ্গে কয়েকটি অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত। এই ৩ লাখ বাইকারের মধ্যে বিভিন্ন অ্যাপ রাইডারের দৈবচয়নের মাধ্যমে ১শ’ জনের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে ২০ তারিখের রাইডের হিসাবে দেখা যায়- ২৬ জন প্রতিদিন গড়ে বাইক চালিয়েছেন ১ ঘণ্টারও কম। ২১ জন চালিয়েছেন দৈনিক ২-৩ ঘণ্টা।
১২ জন চালিয়েছেন ৩-৪ ঘণ্টা। ১৯ জন চালিয়েছেন ৫-৬ ঘণ্টা। আর ২২ জন চালিয়েছেন দৈনিক ৬-১০ ঘণ্টা। দ্বৈত লাইসেন্সধারীদের বাদ দিয়ে মোট রাইডারের সংখ্যার হিসেবে ১ লাখ ২৩ হাজার রাইডার ৫ ঘণ্টা বা অধিক সময় বাইক চালান। তাদের আয়ের প্রধান উৎস বাইক রাইডিং।
আদনান শাহরিয়ার। বয়স আনুমানিক ২৫। অ্যাপভিত্তিক বাইক চালাচ্ছেন প্রায় বছরখানেক ধরে। তিনি বলেন, বাইক চালিয়েই সংসার চালাই। আমার বিয়ে হয়েছে ৪ মাস আগে। আগে একটি স্টেশনারি দোকানে কম্পোজ, ফটোকপি, প্রিন্ট দেয়ার কাজ করতাম। বেতন ছিল ৮ হাজার টাকা। এখন আমি বাইক চালিয়ে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা মাসে আয় করতে পারি।
শুক্রবার রাত ১০টা। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সড়কের পাশে তমাল বিশ্বাস নামে আরেকজন রাইডার অপেক্ষায় যাত্রীর। তিনি আগে একটি প্রাইভেট কোম্পানির বাসের চালক ছিলেন। বেতন পেতেন ১২ হাজার টাকা। চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন ফুলটাইম বাইকার। বলেন, বিয়ের পর বাড়তি আয়ের উৎস খুঁজছিলেন। তাই ধার করে একটি বাইক কেনেন। অফিসের কাজ শেষে চালাতেন বাইক। গেল ঈদে নির্ধারিত ছুটির পাশাপাশি চেয়েছিলেন ২ দিনের অতিরিক্ত ছুটি। কিন্তু সেই ছুটি না দেয়ায় রাগের মাথায় ছেড়ে দেন চাকরি। সেই থেকেই ফুলটাইম রাইডার তিনি। তমাল বলেন, চাকরি ছেড়ে ভালোই করছি। এখন যখন খুশি, যেখানে খুশি, যেতে পারি। মন না চাইলে, শরীর খারাপ থাকলেও কোনো সমস্যা নাই। আর এই বাইক সেবা যারা নিচ্ছেন এমন একাধিক ব্যক্তি জানান, রাজধানীর অসহনীয় যানজট এড়িয়ে দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর সুবিধার কারণেই এই সেবা নিয়ে থাকেন তারা। এ ছাড়া এসব রাইডিং সেবায় প্রায় সবসময়ই থাকে ছাড়। নিয়মিত এসব সেবা নেয়া রিয়েল হোসেন বলেন, গড়ে মাসে ২০ দিনই বিভিন্ন শতাংশে ছাড় থাকে। বর্তমানে আমার দুটি সাইটে ৪০ ও ২০ শতাংশ ছাড় আছে।
অন্যদিকে যেভাবে বাড়ছে বাইকের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট-এআরআই’র হিসাবে ২০১৭ সালে রাজধানীতে ৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৫৩ জন নিহত এবং ১৯ জন আহত হন। গত বছরের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) ঢাকায় ৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৪৭ জনের মৃত্যু এবং ৩৭ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় নিহতদের রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকের পাশাপাশি যাত্রীও ছিলেন।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, এখন বেশিরভাগ মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী হেলমেট ব্যবহার করেন। যা ইতিবাচক। তবে বাইকের পেছনে বসা যাত্রীরা যে হেলমেট ব্যবহার করেন তা মানসম্পন্ন নয়। হেলমেট হতে হবে যেটা মাথাকে পূর্ণ সুরক্ষা দেয়ার পাশাপাশি কান ও থুঁতনি রক্ষা করবে। আর ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বেপরোয়া কিংবা ফুটপাথে মোটরসাইকেল চালানোর দায়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে জরিমানা করা হচ্ছে। এ ছাড়া আমরা সব সময় মোটরসাইকেলের চালকদের সচেতনভাবে ড্রাইভ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।