এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্থাপিত অত্যাধুনিক নিরাপত্তা সরঞ্জামাদির মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এসব মেশিন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত নিরাপত্তা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মান নিয়েও।

সম্প্রতি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা সরঞ্জাম ডিঙিয়ে একের পর এক এক্সপ্লোসিভ (অস্ত্র) ধরা না পড়া ও খেলনা পিস্তল নিয়ে বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনার পর প্রকাশ্যে এসেছে এসব প্রশ্ন। বলা হচ্ছে, তাহলে শত কোটি টাকার স্ক্যানারসহ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইটিডি (এক্সপ্লোসিভ ট্রেস ডিটেক্টর), ইডিএস (এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম) ও ইডিডি (এক্সপ্লোসিভ ডিটেকশন ডগ স্কোয়াড) মেশিন কি কাজ করছে না?

চট্টগ্রামে বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনাটি আন্তর্জাতিকভাবে তোলপাড় হলেও এখনও এর কোনো কূলকিনারা হয়নি। ছিনতাই চেষ্টার সঙ্গে জড়িত পলাশ কিভাবে তার খেলনা পিস্তল ও বোমাসদৃশ বস্তুটি বিমান পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারল, তারও কোনো সুরাহা হয়নি। একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন হলেও কোনোটিরই রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি।

এছাড়া ইলিয়াস কাঞ্চনের বৈধ অস্ত্রটি কিভাবে হেভি লাগেজ গেটের স্ক্যানার পার হল, সে প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর এখনও মেলেনি। উল্টো মন্ত্রণালয় থেকে ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়েছে, বলা হয়েছে তিনি সত্য কথা বলেননি। এর রেশ কাটতে না কাটতে শুক্রবার আবারও একটি অস্ত্র নিয়ে হেভি লাগেজ গেট পেরিয়ে গেছেন এক যাত্রী।

অভিযোগ উঠেছে, শাহজালালসহ দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে যেসব নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও মেশিনপত্র স্থাপন করা হয়েছে এসব নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে কাজ করছে না। নিরাপত্তা যন্ত্রপাতির মধ্যে যে ১৪টি ইটিডি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে সেগুলোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ সঠিকভাবে কাজ করছে না। কিছু কিছু যন্ত্রাংশ বেবিচকের ভাণ্ডারেও নেই। অভিযোগ আছে, মেশিনগুলো পরিচালনার জন্য কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু যন্ত্রাংশ আশপাশের দেশ থেকে ও স্থানীয়ভাবে সস্তায় ক্রয় করে কাজ চালাচ্ছে। এ কারণে অনেক ইটিডি মেশিন থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

কিছুদিন আগে এসব ইটিডি মেশিনের যন্ত্রাংশ ক্রয়ে বড় ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ উঠে। যুক্তরাষ্ট্রের ইটিডি প্রস্তুতকারী কোম্পানি এলথ্রি সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিটেকশন সিস্টেম কোম্পানির কোড নম্বর জালিয়াতি করে স্থানীয় একটি কোম্পানি এসব যন্ত্রাংশ প্রদানের জন্য সিভিল এভিয়েশনকে দরপত্র দেয়। অভিযোগ ওঠে, বেবিচকের কমিউনিকেশন্স শাখার একজন শীর্ষ কর্তার যোগসাজশে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান এ জালিয়াতি করে। বিষয়টি জানতে পেরে খোদ মার্কিন কোম্পানি বেবিচকের কাছে লিখিত অভিযোগ জানায়। অভিযোগে বলা হয়, তাদের সরবরাহকৃত ইটিডি মেশিনগুলোতে যদি অন্য কোনো কোম্পানির যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে এর ওপর তারা কোনো গ্যারান্টি দেবে না। মেশিনগুলো যদি সঠিক তথ্য দিতে না পারে সে জন্য তাদের দায়ী করা যাবে না। এতে ৮ কোটি টাকা মূল্যের ১৪টি ইটিডি মেশিন নষ্ট ও অকেজো হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় ওই চিঠিতে।
জানা গেছে, বেবিচকের মেম্বার অপারেশন এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমানের হস্তক্ষেপে একপর্যায়ে ওই কার্যাদেশ দেয়া বন্ধ হয়। কিন্তু তারপরও কমিউনিকেশন্স শাখার একটি সিন্ডিকেট ইটিডি মেশিনগুলোর জন্য সস্তায় যন্ত্রাংশ ক্রয় করে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ কারণে বেশ কয়েকটি মেশিন এখন এক্সপ্লোসিভ (অস্ত্র) শনাক্ত করতে পারছে না, দিতে পারছে না সঠিক তথ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি মেশিনগুলো ডিঙিয়ে একের পর এক অস্ত্র চলে যাওয়ার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের এলথ্রি সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিটেকশন সিস্টেম কোম্পানি তাদের সরবরাহকৃত মেশিনগুলোর সঙ্গে ৬ মাসের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ দিয়ে দেয়। এর মধ্যে অ্যালকোহল ওয়াইপ, কটন সোয়াব, ফিল্টার স্ক্রিন, স্যাম্পল পাথ, ফিল্টার সিভ ক্যান, স্যাম্পল ট্র্যাপস, থার্মাল পেপার রোল, গ্লোভস নাইট্রাইল (মিডিয়াম) অন্যতম। এসব পার্টস মেশিনগুলোতে ব্যবহার করে স্ক্যান করতে হয়। খোদ এলথ্রি কোম্পানি তাদের চিঠিতে বলেছে, মেশিনে উন্নতমানের যন্ত্রাংশ দেয়া না হলে ভালো রেজাল্ট পাওয়া যাবে না। জানা গেছে, ৬ মাসের যন্ত্রাংশ দিয়ে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ গত দেড় বছর ধরে মেশিনগুলো পরিচালনা করছে। অভিযোগ আছে, কমিউনিকেশন শাখার একটি সিন্ডিকেট নিজেদের পছন্দের কোম্পানির কাছ থেকে এবং স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ ক্রয় করার জন্য এতদিন এ বিষয়ে দরপত্রও আহ্বান করেনি। ইতিমধ্যে অধিকাংশ যন্ত্রাংশ শেষ হয়ে গেছে। ফলে যে কোনো সময় ইডিটি মেশিনগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে মার্কিন সিকিউরিটি কোম্পানির দেয়া আন্তর্জাতিক মানের ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঢাকার বাইরে বদলি করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ কারণে শাহজালালের অনেক জায়গায় দক্ষ জনবলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

বিমানবন্দরে একাধিক অস্ত্র ধরা পড়া প্রসঙ্গে শনিবার বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব এম মহিবুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করুন। যারা দেশের ভাবমূর্তির চিন্তা না করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অস্ত্র নিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশের বিষয়টি এক ধরনের তামাশা জানিয়ে তিনি বলেন, এটা করা একেবারেই সমীচীন নয়। অস্ত্র বহন করার আগে ঘোষণা দেয়া উচিত। এ ধরনের কাজ করে বিমানবন্দরে দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মীসহ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) বিতর্কিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন সচিব এম মহিবুল হক।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের জুনে বিমানবন্দরের দুর্বল নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে বিমান ও নৌপথে সরাসরি কার্গো পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়। ইইউর টিম বাংলাদেশকে উচ্চমাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়াও সরাসরি বিমানে কার্গো পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন চিঠি পাঠান প্রধানমন্ত্রী বরাবর। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে বছরে বাংলাদেশের ৩০ হাজার চারশ’ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হুমকির মুখে পড়ে। পাশাপাশি বড় ধরনের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে। ধস নামে বিমানের কার্গো ব্যবসায়। এ সংকট নিরসনে ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হস্তক্ষেপ করেন। দ্রুত বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিকিউরিটি সরঞ্জাম ক্রয়ে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেন। ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে যুক্তরাজ্যের রেডলাইন নামের একটি সিকিউরিটি কোম্পানিকে নিয়োগ দেয়া হয় শাহজালালে। পুরো বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয় বেবিচকের মেম্বার অপারেশন এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমানকে। তারই হস্তক্ষেপে শাহজালালসহ দেশের সব বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যাপক উন্নতি হয়।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version