এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ঢাকাকে বিশ্বের আধুনিক শহরের মডেলে যুক্ত করতে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এক্ষেত্রে সংশোধিত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) নতুন কিছু কর্মপন্থা যুক্ত করা হয়েছে; যা বাস্তবায়ন হলে রাজউকের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার বিদ্যমান চেহারা অনেকখানি বদলে যাবে। পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর অনেক ঘিঞ্জি ও অপরিকল্পিত এলাকা তখন আর চেনাই যাবে না। মনে হবে সিঙ্গাপুর, জাপান বা কোরিয়ার কোনো আধুনিক শহর।

এছাড়া অবশিষ্ট সমতল ভূমিতে বিচ্ছিন্নভাবে যে যার মতো আবাসিক বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারবে না। রাজউকের মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় নির্ধারিত জায়গা ছেড়ে দিয়ে ভবন করতে হবে।

আবার জনস্বার্থের কথা বলে কারও জমিতে জলাধার, ড্রেন বা বিমান উড্ডয়নের পথ দেখিয়ে কোনো ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে জমির মালিককে বাজারদর অনুযায়ী উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

অপরদিকে রাজউকের বৃহৎ পরিকল্পনার আওতায় যেসব এলাকায় উন্নয়ন হবে, তাদের সরকারের উন্নয়ন ধারা অব্যাহত রাখতে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে হবে এবং আধুনিক ঢাকায় হতে যাওয়া মেট্রোরেল স্টেশনগুলোকে উন্নয়ন প্যাকেজের আওতায় আনা হচ্ছে। এতে করে সরকারের রাজস্ব যেমন বাড়বে, তেমনি ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

ইতিমধ্যে রাজউকের এসব উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব কর্মপন্থার সঠিক প্রয়োগ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সংশোধিত ড্যাপের নতুন কর্মপন্থার মধ্যে রয়েছে- ভূমি পুনঃউন্নয়ন বা রিডেভেলপমেন্ট, ভূমি পুনঃবিন্যাস, উন্নতি সাধন ফি, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপন পন্থা।

রাজউকের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য ২০ বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনা ২০৩৫ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া ঢাকা শহরের এ মাস্টারপ্ল্যান গেজেট আকারে আগামী জুনে প্রকাশিত হবে।

এ লক্ষ্যে সার্বিক কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ভূমি পুনঃউন্নয়ন; কর্মপন্থার মাধ্যমে পুরাতন ঘিঞ্জি জনপদকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলা সম্ভব। সিঙ্গাপুর, জাপান, কোরিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এ কর্মপন্থা বাস্তবায়ন করে পুরনো শহরগুলোকে আধুনিক শহরে রূপান্তরিত করেছে।

ভূমি পুনঃবিন্যাস; কর্মপন্থার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের একত্রিত করে সড়ক, উন্মুক্ত স্থান, পুকুর, ডোবা, খেলার মাঠসহ অন্য নাগরিক সুবিধার উপকরণ সৃষ্টি করা হবে।

এতে করে তারা সুন্দর ও বাসযোগ্য পরিবেশ পাবে। বিনিময়ে তাদের সামান্য পরিমাণ জমি ছেড়ে দিতে হবে। এটা সরকারি বা বেসরকারি উভয় উপায়ে হতে পারবে। উন্নয়ন সাধন ফি; কর্মপন্থার মাধ্যমে সরকারের প্রচুর বিনিয়োগের ফলে মূল্যবান হয়ে ওঠা সম্পদের মালিকদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফি আদায় করা যাবে। এতে করে সরকারের রাজস্ব বাড়বে, যেটা সরকার অন্য উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যবহার করতে পারবে।

ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন কর্মপন্থা হল- মেট্রোরেল স্টেশন বা এ ধরনের স্টেশনগুলোকে পরিকল্পিতভাবে অপেক্ষাকৃত লাভজনক কাজে ব্যবহার করা। এখান থেকে কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো সম্ভব। আর উন্নয়ন স্বত্ব প্রতিস্থাপন পন্থার মাধ্যমে জনস্বার্থে ব্যবহৃত (যেমন- জলাধার, খাল, বিমান রুট) ভূমির ক্ষতিগ্রস্ত মালিকরা ক্ষতিপূরণ পাবেন।

এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, রাজউকের সংশোধিত ড্যাপে রিডেভেলপমেন্টসহ বেশ কিছু নতুন কর্মপন্থা রাখছে বলে জেনেছি। কর্মপন্থা হিসেবে এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের অনেক দেশ এসব কর্মপন্থা বাস্তবায়ন করে ঘিঞ্জি জনপদ থেকে আধুনিক শহর গড়ে তুলেছে। এসব কর্মপন্থা বাস্তবায়ন করে ঢাকাকেও বিদ্যমান অবস্থা থেকে উন্নত করা সম্ভব হবে। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজন এসব কর্মপন্থার সঠিক ও স্বচ্ছ বাস্তবায়ন।

এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, রাজউকের প্রথম ড্যাপ নিয়ে মানুষের অনেক অভিযোগ ছিল। সেসবের অনেক ক্ষেত্রে সত্যতাও ছিল। কেননা সেখানে অনেক ভুল-ত্রুটি ছিল। সংশোধিত ড্যাপে সেসব সংশোধন করে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে ভূমি উন্নয়নসহ বেশ কিছু কর্মপন্থা দেয়া হচ্ছে। সেসব কর্মপন্থা নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বাস্তবায়ন করে ঢাকা শহরকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। যেমন- পুরান ঢাকায় আমরা ভূমি উন্নয়ন করে নতুন করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। আশা করি প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় এটা করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজউক সংশোধিত ড্যাপে ভূমি পুনঃউন্নয়ন, ভূমি পুনঃবিন্যাস, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়নসহ বেশ কিছু নতুন কর্মপন্থা সুপারিশ করছে। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে এসবের বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করছে সবকিছু, যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে এসব কর্মপন্থা নগরীর কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না।

রাজউকের সংশোধিত ড্যাপে জনবান্ধব আরও কিছু কর্মপরিকল্পনা থাকছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিদ্যমান বিতর্কিত ড্যাপের দুর্নাম ঘোচাতে এবার অন্যসব ক্ষেত্রেও বেশ পরিবর্তন আসছে। সংশোধিত ড্যাপ সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ার পর মেট্রোপলিটন এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং পেশাজীবীদের সঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে বড় পরিসরে এবং বিষয়ভিত্তিক সমন্বয় সভার আয়োজন করা হবে। ওই সভায় রাজউকের পরিকল্পনা উইং থেকে ড্যাপের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও মূল বিষয়বস্তু এবং করণীয় উপস্থাপন করা হবে।

সেসব প্রস্তাবনায় ভূমি ব্যবহার, উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা, যানবাহন, ড্রেনেজ, পরিবেশ ও অর্থনীতি প্রভৃতি স্থান পাবে। আর ড্যাপের পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা অথবা বাস্তবায়নকারী সরকারি-বেসরকারি সংস্থার চিন্তা-ভাবনা বোঝার জন্য প্রতি ছয় মাস অন্তর ড্যাপ রিভিউ সভা আহ্বান করা হবে।

এসব সভায় ড্যাপের নির্দেশিত নীতিমালা, সুপারিশগুলোর পরিমার্জন বা পরিবর্ধন লাগবে কিনা, সে ব্যাপারে যৌক্তিক দিকনির্দেশনা দেয়া হবে। এটা ড্যাপের সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। এ মাস্টারপ্ল্যান প্রতি পাঁচ বছর অন্তর হালনাগাদ করা হবে। ড্যাপভীতি দূর করতে ড্যাপের গেজেট ও ম্যাপ রাজউকের আওতাধীন এলাকার সব সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় পাঠানো হবে।

এছাড়া এ ব্যাপারে ড্যাপের পরিকল্পনা গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যাপকভাবে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করা হবে। রাজউকের ড্যাপের এবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল- শহরবাসীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।

পরিকল্পনা প্রণয়নে যেমন রাজউকের আওতাভুক্ত সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও পেশাজীবী সংস্থার মতামত বিবেচনায় নেয়া হয়েছে, তেমনি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়ও এলাকাবাসীর মতামত আমলে নেয়া হবে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version