ড. মাহবুব উল্লাহ্ : নৃ-তত্ত্ববিদরা গবেষণা করেন মানুষের মানুষ হয়ে ওঠা নিয়ে। এ ধরনের গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য হল কীভাবে মানব প্রজাতির বিবর্তন ঘটেছে।

কিন্তু ওটুকু হলেই মানুষের মানুষ হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। মানুষের মধ্যে থাকতে হয় মানবিক গুণাবলী। এসব গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ ও প্রীতি এবং একে অপরের শোকে দুঃখে সমব্যথী হওয়া। শিল্প, সভ্যতা ও সংস্কৃতির নজিরবিহীন অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও আমরা কি দাবি করতে পারি, মানুষ হওয়ার যোগ্যতা আমরা অর্জন করেছি?

দাস ও সামন্ত যুগের নিষ্ঠুরতার ছাই ভস্মের ওপর দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদের উদ্ভব একটি মানবিক বিশ্বের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। পুঁজিবাদ মানুষে মানুষে সম্পদ বণ্টনের অসাম্য দূর করতে পারেনি, বরং সেই অসাম্য দিনে দিনে তীব্র হয়েছে।

সম্পদ সাম্যের নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও পুঁজিবাদ মানুষে মানুষে Formal Equality-র কথা বলেছে। অর্থাৎ আইনের চোখে সব মানুষ সমান বলে বিবেচিত হবে। মার্কিন স্বাধীনতা ঘোষণার দলিলে বলা হয়েছিল, All men are created equal. একটি সুস্থ সভ্যতার পথে পদক্ষেপ হিসেবে পুঁজিবাদের এ অবদান অস্বীকার করা যায় না।

কিন্তু এই পুঁজিবাদের অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে উপনিবেশবাদ, এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশের সম্পদ লুণ্ঠন। এ ছাড়াও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল নাজিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও টোটালেটেরিয়ানিজমের মতো অমানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। ছড়িয়েছে বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষসহ সব ধরনের বিদ্বেষের বিষবাষ্প।

বার্লিন ওয়ালের পতনের পর সাম্প্রতিক যুগের বিশ্বায়নের পর্ব সূচিত হয়েছিল। আশা করা গিয়েছিল মানুষে মানুষে যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষ একে অপরকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেবে। কিন্তু তাও সম্ভব হয়নি।

বিশ্বায়ন যেমন একদিকে মানচিত্রের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিতে চায়, অন্যদিকে তেমনি এমন সব বাধা ও দূরত্বের দেয়াল সৃষ্টি করে যার ফলে মানুষে মানুষে দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। এটি এক বিপরীতমুখী ইতিহাসের ধারা। সূচনাপর্বে বিশ্বায়ন বিশ্ব বাণিজ্যকে শুল্ক দেয়াল থেকে অনেকটাই মুক্ত করেছিল।

কিন্তু আবার এর বিপরীতমুখী ধারা হিসেবে শুরু হয়েছে শুল্কযুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে স্লোগান দিয়ে নির্বাচনী সাফল্য অর্জন করেছেন সেই স্লোগান এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি মুক্ত সমাজকে ঘৃণা-বিদ্বেষের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলছে। পৃথিবীতে শুরু হয়েছে নতুন আধিপত্যবাদের দ্বন্দ্ব। বিশ্বায়নের সূচনা পর্বে দেশে দেশে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিবাসনের যে প্রক্রিয়াকে দৃঢ়মূল করছিল সেই প্রক্রিয়া এখন অভিবাসী বিদ্বেষের কবলে পড়ে স্তব্ধ হতে চলেছে।

সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে গেল ১৫ মার্চ শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ নামক ছোট একটি শহরে। সেখানে শ’তিনেক মুসলিম অভিবাসীর বাস।

১৮৫০ সালে সর্বপ্রথম মুসলমানরা সেখানে বসতি স্থাপন করেছিল। এরপর গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে এ অভিবাসন প্রক্রিয়া আরও বিস্তার লাভ করে। শুক্রবার মুসলমানরা মসজিদে সমবেত হয়ে জুমার নামাজ আদায় করে। ক্রাইস্টচার্চে ২টি মসজিদ আছে। দুটিতেই স্থানীয় মুসলমানরা জামাত করে জুমার নামাজ আদায় করে।

সেজাদরত মুসলমানদের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করে এক অমুসলিম যুবক। প্রথমেই আক্রান্ত হয় আল-নূর মসজিদের মুসল্লিরা। আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে লিনউডের শহরতলীর একটি মসজিদে। তবে পরের আক্রমণটি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। পুলিশ মোটর গাড়ির সঙ্গে সংযুক্ত কিছু বিস্ফোরক হাতিয়ারও উদ্ধার করেছে।

এ পর্যন্ত ৪৯ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অন্যরা মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। তবে শহরটি এতই ছোট যে সেখানে এত সংখ্যক গুলিবিদ্ধ মানুষকে চিকিৎসা দেয়ার মতো অতিরিক্ত হাসপাতালও নেই। যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তারা সবাই ছিলেন নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ।

একজন মুসল্লির ভাষ্য অনুযায়ী ৬ মিনিটের মতো সময়ে পুরো ঘটনাটি ঘটে গেছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে আমরা সভ্য দেশ বলি। এটাই কি সভ্যতার নমুনা?

কর্তৃপক্ষ পূর্বাহ্নে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে কোনো আঁচ করতে পারেনি। অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক এ ঘটনায় তিনজন বাংলাদেশিও নিহত হয়েছেন। এদের একজন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। পরে তিনি নিউজিল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন।

বাংলাদেশের ক্রিকেট দল সেখানে গিয়েছিল ক্রিকেট খেলতে। এ ক্রিকেট খেলোয়াড়রা জুমার নামাজ আদায় করতে একটি বাসে করে আল-নূর মসজিদের দিকে যায়। কিন্তু তারা পৌঁছেছিল ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার ৩-৪ মিনিট পর। এর ফলে তারা ঘৃণায় উন্মত্ত যুবকটির আগ্নেয়াস্ত্রের হামলা থেকে দৈবক্রমে রক্ষা পায়।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিরাপত্তাজনিত কারণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশে ফেরার ঘোষণা দিয়েছে। কথায় বলে হায়াত ছিল বলে এরা বেঁচে গেছে। তা না হলে বাংলাদেশের পুরো ক্রিকেট টিমটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।

ক্রিকেট খেলোয়াড় হোক বা না হোক, প্রত্যেক বাংলাদেশির জীবন আমাদের কাছে অমূল্য। তারপরও সৃষ্টিকর্তার কাছে পরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলতে হয় এ ছিল আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডে যারা শিকার হয়েছেন তারা যে দেশ থেকেই আসুন না কেন সেসব দেশের জনগণকে জানাই গভীর সমবেদনা।

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলাকারী ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। হামলাকারীর পরিচয় নিশ্চিত করে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, হামলাকারী কট্টর ডানপন্থী।

অবশ্য তিনি তার নাম প্রকাশ করেননি। প্রত্যক্ষদর্শী কারও কারও মতে, হামলাকারী একাধিক ছিল। হামলায় জড়িত সন্দেহে এক নারীসহ ৪ জনকে পুলিশ আটক করেছে। হামলাকারী যুবকটি ২৮ বছর বয়সী বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ হামলাকারী এতটাই বিদ্বেষপরায়ণ ছিল যে, সে ফেসবুকে পুরো হামলার দৃশ্য লাইভ স্ট্রিম করেছে।

ফেসবুক কর্তৃপক্ষ প্রায় দেড় ঘণ্টা পর চিত্রটি ছেঁটে দিলেও পুরো বিশ্ববাসী ঘটনার নৃশংসতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে গেছে। কট্টর ডানপন্থী এ যুবক যে লক্ষ্য হাসিল করতে চেয়েছিল সেই লক্ষ্য হাসিল করে ফেলেছে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন জানিয়েছেন, হামলাকারী নিরাপত্তা নজরদারির তালিকায় ছিল না। এটা কেমন করে সম্ভব?

সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে হামলাকারী সোশ্যাল মিডিয়াতে তার ৭০ পৃষ্ঠারও বেশি মেনিফেস্টো প্রচার করেছিল। ভিডিওতে দেখা গেছে হামলাকারী স্বয়ংক্রিয় বন্দুক নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সমজিদের দিকে যাচ্ছে। মসজিদের প্রবেশ কক্ষ থেকেই মুসল্লিদের ওপর নির্বিচারে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে সে।

মসজিদের ভেতর ছোটাছুটিরত মুসল্লিদের প্রতি একটানা গুলি করা হয়। এরপর মসজিদের এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ঘুরে ঘুরে সে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে যারা মসজিদের মেঝেতে পড়েছিলেন তাদের দিকে ফিরে ফিরে সে গুলি চালিয়েছে।

২৮ বছর বয়সী এ শ্বেতাঙ্গ যুবক অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে। দুই বছর ধরে সে এ হামলার পরিকল্পনা করেছে। হামলাকারী জানিয়েছে, ইউরোপের দেশগুলোয় বিদেশি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে সে এ হামলার পরিকল্পনা করে।

ঘৃণা-বিদ্বেষ-প্রতিশোধপরায়ণতা মানুষকে কত অমানুষে পরিণত করতে পারে, নিউজিল্যান্ডের ঘটনা তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বার্লিন ওয়ালের পতনের পর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছিলেন, গণতন্ত্রের চতুর্থ জোয়ার শুরু হয়েছে। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার মতো পণ্ডিত ব্যক্তি এ থেকে উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে, ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। নব্য উদার নীতিবাদী পুঁজিবাদ এবং গণতন্ত্রই হবে আগামী পৃথিবীর নিরন্তর ভবিষ্যৎ। কিন্তু ফুকুইয়ামার এ ভবিষ্যদ্বাণীর ৩০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পৃথিবী হয়ে উঠেছে গণতন্ত্রের জন্য অনিশ্চিত এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতির জন্য সম্ভাবনাহীন। ইউরোপের বেশ কিছু সভ্য-শান্ত দেশে অতি দক্ষিণপন্থী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। উদার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে করে তুলছে অনিরাপদ। যে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ৩০ বছর আগে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েভ (www) উদ্ভাবন করেছিলেন তিনিও এ উদ্ভাবনার কল্যাণ শক্তি সম্পর্কে দ্বিধা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের বিশাল তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশের এ সুযোগ যেভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্যগুলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছে, ঠিক তারই বিপরীতে অকল্যাণ, অমঙ্গল ও ঘৃণা বিদ্বেষের বিষবাষ্পকেও ছড়িয়ে দিচ্ছে। শত প্রকার ফিল্টারের ব্যবস্থা করেও একে থামানো যাচ্ছে না।

আলো ও অন্ধকার যেভাবে পারস্পরিকভাবে আসা-যাওয়া করে ঠিক তেমনি প্রযুক্তিগত কল্যাণ ও অকল্যাণ হাত ধরাধরি করে চলে। কিন্তু এগুলো তো মানুষেরই সৃষ্টি। মানুষের সৃষ্টিতে যেমন থাকে সমৃদ্ধি ও সৌহার্দ্যরে সম্ভাবনা, একইভাবে থাকে যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ, রক্তপাত, ঘৃণা ও বিদ্বেষের অপরিহারযোগ্য পরিণতি। কবে বিশ্বের সব মানুষ প্রকৃত অর্থেই মানুষ হবে? ছোটবেলায় এক কবির লেখায় পড়েছিলাম, কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর / মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতেই সুরাসুর। ভুপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, নামাও তাকে ধরার পর। সেই ভুপেন হাজারিকাও জীবন সায়াহ্নে হয়ে গেলেন সাম্প্রদায়িক বিজেপির অনুসারী। মানুষ কেন বদলে যায়, তার জবাব কি আমরা জানি? তবে এটুকু বুঝি এ শতাব্দীর পরবর্তী সময়টুকু হবে বিদ্বেষ ও হানাহানির হলাহলে রক্তাক্ত!

ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version