সাধারণত, এই চিলেশন থেরাপিতে রোগীকে সপ্তাহে দুদিন ডাক্তারের কাছে যেতে হয় এবং সর্বমোট ৩০টির মতো সেশনের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি সেশনে লাগে ঘণ্টা দুই করে। পর্যায়ক্রমিকভাবে এই চিকিৎসা গ্রহণের ফলে রোগীর ধাপে ধাপে উন্নতির বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চিলেশন থেরাপির ফলে হৃৎপিণ্ডে এবং দেহের অন্যান্য অংশে অর্থাৎ মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়- প্রদাহ হ্রাস পায় এবং অনেক ক্ষুদ্র ধমণী চালু হয়ে যায়।

বহির্বিশ্বে বহু রোগী এখন এই থেরাপি গ্রহণ করেন। শুধু দেহের বাড়তি দূষণ পদার্থ, যেমন হেভি মেটাল কমানোর জন্য। আমাদের প্রত্যেকের দেহেই এই ভারি ধাতব জমা হয় এবং কখনো কখনো তা বিষক্রিয়া ঘটায়। ফলে বিভিন্ন রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। বহু অশনাক্ত রোগের উপশম ঘটানোয়ও এই চিলেশন থেরাপির অবদান রয়েছে।

হৃদরোগ চিকিৎসায় এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারিতে যথেষ্ট ঝুঁকি আছে, এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে- এসব জেনেও মানুষ কেন অপারেশনের দিকে ঝোকেন? এর সহজ উত্তর হলো, বস্তুগত বিচারের ফলাফল বিবেচনার চাইতে এর তাৎক্ষণিক কার্যকারিতার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেন তারা। তা ছাড়া এই চিলেশন থেরাপি সম্পর্কে তারা জানতে পারেন না বলেই উপায়হীনভাবে অপারেশন করান। ইডিটিএ চিলেশন থেরাপি বিনা অপারেশনের একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যা মেটাবলিকের উন্নতি ঘটায় এবং নানাভাবে রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়াকে গতিশীল রাখে। একইসাথে দেহে ধাতব আয়নে সামঞ্জস্য নিয়ে আসে, ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দেয়। ইডিটিএ ও এমিনো এসিডের এই থেরাপির জন্য ব্যয়বহুল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগে না, ডাক্তারের চেম্বারেই গ্রহণ করা সম্ভব। অনেকটা সেলাইন নেয়ার মতোই।

চিলেশন থেরাপি প্রয়োগকারী সন্তুষ্টি প্রকাশের বদলে অবাক হয়েছেন একাধিক রোগের লক্ষণ প্রকাশের পরও সেগুলোর উন্নতি ঘটতে দেখে। এগুলোর ভেতর রয়েছে : এনজিনা, স্ট্রোক, হার্ট ফেইলিওর, আর্থেরাইটিস, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। একবার ইডিটিএ রক্তধারায় মিশে গেলে তা রক্তে অতিরিক্ত মৌলিক পদার্থ জমতে বাধা দেয়, দেহকোষ ও প্রত্যঙ্গকে ক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। দেহে পুষ্টিজাতীয় উপাদানের পাশাপাশি ধাতব উপাদানের ক্ষেত্রেও একটা সামঞ্জস্য নিয়ে আসে। ফলে স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।

বিজ্ঞানীরা এক পর্যায়ে এই থেরাপির ফলে ভিটামিন সি ও ই, সেলেনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, বেটা ক্যারোটিনসহ অন্যান্য উপাদানের সংযুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেন- তখন এসবের বায়োলজিক্যাল এন্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান বিষয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করলেন। এসব গবেষণার ফল এলো ইতিবাচক এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট সংক্রান্ত বিবেচনায় চিলেশন থেরাপির গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত হলো। আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই থেরাপি কেবল হৃদযন্ত্রের আশেপাশের ধমনীর জন্যই কার্যকর ভূমিকা রাখে না; দেহের অন্যান্য অংশের ধমনী, এমনকি হাত-পায়ের আঙুল এবং মস্তিষ্কের ধমনীর জন্যও উপকার বয়ে আনে।

প্রতি বছর ৬০ হাজারের মতো মানুষ তাদের পা হারায় গ্যাঙগ্রিনে, ধমনীতে ব্লকেজ সৃষ্টি হয়ে। স্ট্রোক করে মারা হায় বহু লোক। ঘাড়-মাথা-পায়ের ধমনীতে বাইপাস সার্জারি এখন সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে। অথচ প্রতিটি ক্ষেত্রে ঝুঁকিহীনভাবে চিকিৎসা করতে পারে চীলেশন থেরাপি।

তেমন কোনো লক্ষণই নেই কোনো মারাত্মক ব্যাধির, কিন্তু পরিবেশগত বিপর্যয়, বংশানুক্রমে পাওয়া রোগ, ধূমপান, অতিভোজন, এবং জীবনধারার কারণে প্রৌঢ়ত্বে। এসে কোনো একটা ব্যাধি শরীরে বাসা বাঁধতেও পারে। তাই সাবধান থাকা জরুরি। জৈবিক কোনো সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা না থাকলে আপনিও নিজেকে ভয়ঙ্কর কিছু রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন এই আগাম থেরাপি গ্রহণের মাধ্যমেই। রোগগুলো হলো : ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আর্থিরাইটিস, পারকিনসন্স, আলঝাইমার, অ্যাথেরোসক্লেরোসিস, এমনকি ক্যান্সার। বার্ধক্যজনিত রোগ আলঝাইমারে ভোগেন মধ্য আশির ব্যক্তিরা। বড় ক্ষতির আগে প্রতিরোধ গ্রহণই কি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়? তাই নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা যায় চিলেশন থেরাপি।

চীলেশন একটি যুগান্তকারী দীর্ঘায়ু দানকারী চিকিৎসা পদ্ধতি যা অনেকগুলো বার্ধক্যজনিত ব্যাধির বিরুদ্ধে আগেভাগেই আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। চীলেশন শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘চিলে’ থেকে, যার অর্থ হলো ‘থাবা’। চিলেটিং এজেন্টস এক ধরনের পদার্থ যা শরীরের বিষাক্ত খনিজ, ধাতব ও রাসায়নিক পদার্থের সাথে মিলে রাসায়নিক যৌগ গঠন করতে পারে। এ যৌগগুলো দেহের অনাকাক্সিক্ষত পদার্থকে ঘিরে ফেলে এবং পরে সেগুলিকে মল-মূত্রের সাথে করে দেহ থেকে বের করে দেয়। ১৯১৩ সালে ওয়ার্নার তার এ আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন এবং চিলেশন রসায়নের এই বিজ্ঞানটিকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজ এগিয়ে নেন।

অন্যান্য মেডিক্যাল চিকিৎসার তুলনায় চিলেশন থেরাপি একটি ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা। এতে কোনো ব্যথাবেদনা নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী কোনো অসুবিধা বোধ করেন না। চেয়ারে হেলান দিয়ে বই পড়তে পড়তে কিংবা টিভি দেখতে দেখতে অনেকটা স্যালাইন গ্রহণের মতো এটি গ্রহণ করা যায়। দরকার হলে রোগী এটি গ্রহণ করতে করতে রুমের ভেতর হাঁটাচলাও করতে পারেন। শিরার সাথে সংযুক্ত নিডলটি সরে না গেলে রোগী ফোনে কথা চালিয়ে যেতে পারেন, অথবা পানাহারও করতে পারেন। বহির্বিশ্বে অনেক রোগী চিলেশন থেরাপি গ্রহণ করতে করতে কম্পিউটারে তাদের দৈনন্দিন ব্যবসায়িক কাজকর্মও চালিয়ে যান।

সত্যি বলতে কি, অন্যান্য চিকিৎসাপদ্ধতির সাথে তুলনা করলে বলতেই হবে যে, সাধারণভাবে এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এটি সম্পূর্ণ ঝুঁকিহীন চিকিৎসা। আধুনিক বিশ্বে রোগীরা চিলেশন থেরাপি নেয়ার পর দিব্যি গাড়ি চালিয়ে ঘরে চলে যাচ্ছেন। বাইপাস সার্জারিতে যেখানে ১০০ জনের ভেতর তিনজনের মৃত্যু হয় বলে পরিসংখ্যানে জানা যায়, সেখানে দশ হাজার রোগীর ভেতর মাত্র একজনের ক্ষেত্রে চিলেশন থেরাপি গ্রহণের জন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, তবে মৃত্যুর ঘটনা নয়। তাই বলা হয়ে থাকে, চিলেশন থেরাপি বাইপাস সার্জারির তুলনায় তিন শ’ শতাংশ নিরাপদ। তবে যে কোনো ব্যাপারেই অতিডোজ ক্ষতিকর। চিলেশন থেরাপির ক্ষেত্রেও মাত্রাতিরিক্ত ডোজ বিপদ ডেকে আনতে পারে। সেজন্যেই আমেরিকায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চিলেশন থেরাপি দিলে ঝুঁকির মাত্রা একেবারে নিম্নপর্যায়ে চলে আসে।

একবার রাষ্ট্র করে দেয়া হলো যে, চিলেশন থেরাপি কিডনি বিকল করে ফেলে। পরে ৩৮৩ জন রোগীর ওপর গবেষণায় চিলেশন থেরাপি গ্রহণের আগে ও পরে পরীক্ষা করে ঠিক তার উল্টো ফল পাওয়া যায়। প্রত্যেকেরই কিডনি ফাংশানে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। কিডনির জন্য ওভারলোড হয়ে যাওয়ার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক বিষয়টি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণে সক্ষম। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, জটিল কিডনি সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের চিলেশন থেরাপি নেয়া উচিত নয়।

চিলেশন থেরাপি কিন্তু নতুন চিকিৎসা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা অন্য ধরনের চিলেশন এজেন্ট ব্যবহার করত। তার নাম ব্রিটিশ অ্যান্টি-লিউসাইট এটি বিষাক্ত গ্যাসের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখনো বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। আমেরিকায় ১৯৪৮ সালে ব্যাটারি কারখানার লিড-বিষে। আক্রান্ত শ্রমিকদের চিকিৎসায় প্রথম এটি ব্যবহৃত হয়। এরপর আক্রান্ত রঙ-কারিগরদের ওপরেও একই চিকিৎসা প্রয়োগ করা হয়। ১৯৫৫ সালে আমেরিকার মেডিক্যাল জার্নালে এ বিষয়ে প্রবন্ধ বের হয়। আথ্রোসক্লেরোসিস চিকিৎসায় যুগান্তকারী সাফল্যের কারণেই ওইসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রথম দিকে, চিকিৎসকেরা এ চিকিৎসা পদ্ধতির নাটকীয় সাফল্যে বিস্মিত হয়ে যেতেন। এমনকি ডায়াবেটিক আলসার ও গ্যাঙগ্রিনে আক্রান্ত পায়ের উন্নতি হতো মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে।

বর্তমানে আমেরিকার এক হাজার ৫০০ এর অধিক ডাক্তার এবং অন্যান্য দেশে বহু ডাক্তার এই চিলেশন থেরাপি চিকিৎসা দিয়ে আসছেন নিয়মিতভাবে। আনন্দের সংবাদ এই যে আমাদের বাংলাদেশেও এই চিলেশন থেরাপির কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে ৫৭/১৫ পশ্চিম পান্থপথস্থ করোনারি আর্টারি ডিজিস প্রিভেনশন অ্যান্ড রিগ্রেশান (সিএডি পিআর) সেন্টারে। আমেরিকায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা চিলেশন থেরাপিতে সফল হলে তা হবে আমাদের দেশের জন্য একটি বিস্ময়কর ঘটনা।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version