নানা অনিয়ম, কেলেঙ্কারি, জালিয়াতি ও অব্যবস্থাপনায় ডুবতে বসেছে ২২ বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যাচাই-বাছাই ছাড়াই আগ্রাসীভাবে দেয়া হচ্ছে ঋণ, যা আদায় হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। লাগামহীন খেলাপি ঋণের প্রভাব পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধনে। এ অবস্থায় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ইতিমধ্যেই নাজুক অবস্থায় থাকা ১২ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে রেড জোন বা লাল তালিকাভুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা জানান, বর্তমানে পুরো ব্যাংক খাত কয়েকটি কারণে দুরবস্থায় পতিত। একদিকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, তারল্য সংকট বিরাজমান ও ঋণের উচ্চ সুদহার। কিন্তু অন্যদিকে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বাড়ছে।

এটা কোনো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই চার সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে ব্যাংক।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকারী আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল মনে করে সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ভালো অবস্থানে রয়েছে। ভালো প্রবৃদ্ধির পরও দেশের ব্যাংক খাত ক্রমশ আরো খারাপের দিকেই যাচ্ছে কেন? একই সঙ্গে সংস্থাটি বলেছে, প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে ব্যাংক খাতের সংস্কার ও কর আদায়ের হার বৃদ্ধিতে সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত সমস্যার মধ্যে চলছে। প্রকৃত তথ্যের অভাবে অপাত্রে ঋণ যাচ্ছে। যারা ঋণ পাওয়ার যোগ্য নন তারাই ঋণ পাচ্ছে। এতে করে বাড়ছে ঋণখেলাপি। এটি এখন ব্যাংক খাতের মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিলো ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। ১০ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। এর থেকে অবলোপন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। ‘অবলোপন’ হলো হিসাব থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে যে ঋণ। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। ২০০৯ সালের তুলনায় যা ৭১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা বেশি।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ওয়াহেদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘ঋণ পুনর্গঠনের শর্ত শিথিল’ ও ‘খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন’ করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা ঋণ নিয়েছেন, তারা ফেরত না দেয়ার পেছনে নীতিগত পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন।
জানা গেছে, লাগামহীনভাবে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১০টি ব্যাংক মূলধন সংকটে পড়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতিনীতি অনুযায়ী, একটি ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেই পরিমাণ মূলধন রাখতে হয়। ঝুঁকি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে ১০ শতাংশ ন্যূনতম মূলধনের পাশাপাশি ০.৬২ শতাংশ হারে অতিরিক্ত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। এ হিসাবে চলতি বছরের মার্চ শেষে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে ১০টি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মার্চ শেষে মূলধন ঘাটতি সবচেয়ে বেশি রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ৮ হাজার ৮৮৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। মূলধন ঘাটতির দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ৪ হাজার ৮৮৮ কোটি আট লাখ টাকা। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের ১ হাজার ৫৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা, বেসিক ব্যাংকের ২৩৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের ১৫৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ৭৩৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে।

বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৫৬৯ কোটি ৯ লাখ টাকা। ঘাটতিতে থাকা অন্য দুই ব্যাংকের মধ্যে এবি ব্যাংকের ৩৭৬ কোটি ৭৪ লাখ এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৪৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এছাড়া বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ৫৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার মূলধন ঘাটতি পড়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন পর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট থেকে কোনো অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি মূলধন ঘাটতিতে থাকা রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোকে। তবে ব্যবসা টিকিয়ে ভর্তুকি বাবদ দুটি ব্যাংকের জন্য ১৫১ কোটি ১২ লাখ টাকা ছাড় করা হয়। যদিও সরকারি ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে মূলধন ঘাটতি পূরণে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল।

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা ২০১৮ এর ডিসেম্বর শেষে ছিল ৯৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নাজুক পরিস্থিতির মূল কারণ হলো, সুশাসনের অভাব। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তো রয়েছেই। ফলে বিভিন্ন চাপের কারণে ব্যাংকগুলোরও কিছুই করার থাকে না। এ কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ফলে ব্যাংকগুলো মূলধনও খেয়ে ফেলছে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। সরকারকেও সহযোগিতা করতে হবে বলে মনে করেন সাবেক এই গভর্নর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের এনবিএফআইগুলোর মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠান ‘লাল’, ১৮টি প্রতিষ্ঠান ‘হলুদ’ ও মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠান ‘সবুজ’ রঙে চিহ্নত করা হয়েছে। পিপলস লিজিং অবসায়িত হওয়ায় বর্তমানে দেশে এনবিএফআই’র সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩টিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিআইএফসি, পিপলস লিজিং ও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের। বিআইএফসির মোট ঋণের ৯৬ শতাংশ খেলাপি। কোনো পরিচালন আয় না থাকায় প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৬ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিআইএফসিতে রয়েছে মাত্র ২৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৭.৪৬ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে পিপলস লিজিংয়ের। আর ফার্স্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৯.৬৫ শতাংশ। প্রয়োজনের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির মূলধন কম রয়েছে ২০ কোটি টাকা। ফার্স্ট ফাইন্যান্সের অডিটর প্রতিষ্ঠানটির ২০১৮ সালের অডিট রিপোর্টের ওপর বিশেষ পর্যবেক্ষণ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ৪৬ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে, যা পূরণের সক্ষমতা না থাকায় বিশেষ বিবেচনায় ৫ বছর সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রিমিয়ার লিজিং নামের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের ২৮.৭৮ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মূলধন ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ হিসাব বছরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ‘এ’ থেকে ’বি’ ক্যাটাগরিতে নেমে গেছে। পর্যায়ক্রমে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের মোট ঋণের ২৪.২০ শতাংশ খেলাপি। সরকারি মালিকানার ইডকলের খেলাপি ঋণ ২৩.৯৮ শতাংশ। গত বছর সাড়ে ১৬ কোটি টাকা লোকসান করা প্রাইম ফাইন্যান্সের ঋণের ১৭.৮৫ শতাংশ খেলাপি। ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ১৬.৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া এফএএস ফাইন্যান্সের ১৫.৪১ শতাংশ, মাইডাস ফাইন্যান্সিংয়ের ১৪.৩৪ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্সের ১৩.৩৮ শতাংশ এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ১০.২৬ শতাংশ ঋণ খেলাপি। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা বিআইএফসি থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণে অনিয়ম হয়েছে এবং বড় অঙ্কের অর্থ খেলাপি হয়ে গেছে।

একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয়। যার বড় অংশ আসে ব্যাংক থেকে। তবে এখন ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের কারণে নতুন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে চাচ্ছে না। তিনি বলেন, ঋণের বেশিরভাগই খেলাপি হওয়ায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত এবং সময়মতো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে সমস্যা হচ্ছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version