ছেলেধরা সন্দেহে রাজধানীতে এক নারী, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয়রা। শনিবার সকাল নয়টায় ঢাকার উত্তর বাড্ডার কাঁচাবাজার এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গণপিটুনিতে মারা যান ৩৫ বছর
বয়সী এক নারী। তার পরিচয় এখনো জানা যায়নি। এদিকে একইদিন সকালে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার মিজমিজি আল আমিন নগর এলাকায় গণপিটুনিতে নিহত হয় ২৫ বছর বয়সী অজ্ঞাত এক যুবক। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকাল সাড়ে আটটার দিকে এক নারী উত্তর পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় স্কুলের সামনে প্রবেশপথে থাকা অভিভাবকেরা তাকে ভেতরে যাওয়ার কারণ জানতে চান। ওই নারী সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাবেন বলে জানান। স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি নেয়া হচ্ছে না জানিয়ে ওই নারীকে প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে নেয়া হয়।

এ সময় চারপাশে খবর ছড়িয়ে পড়ে, স্কুলে ছেলেধরা এসেছে। এ খবরে স্কুলে লোকজন ভিড় জমায়। এর কিছুক্ষণ পরই ছেলেধরা সন্দেহে স্কুলের বাইরে এনে ওই নারীকে গণপিটুনি দেয়া হয়। পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি মারা যান। পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে নারীর নাম-পরিচয় এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, নারায়ণগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে পৃথক দু’টি ঘটনায় গণপিটুনিতে অজ্ঞাত এক যুবক (২৫) নিহত ও অজ্ঞাত এক নারী (২৪) গুরুতর আহত হয়েছেন। ঘটনা দু’টি ঘটেছে গতকাল সকালে সদর উপজেলার সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পূর্বপাড়া আল আমিন নগর ও পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকায়। খবর পেয়ে পুলিশ অজ্ঞাত যুবককে উদ্ধার করে। অপরদিকে পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকায় রেশমা ওরফে শারমিন নামে ওই নারীকে উদ্ধার করতে গেলে এলাকাবাসীর সঙ্গে পুলিশের আধা ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এবং ওই নারীকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে থানায় ও পরে হাসপাতালে পাঠান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গতকাল সকাল ৮টার দিকে মিজমিজি আল আমিন নগর এলাকার আইডিয়াল কিন্ডার গার্টেন স্কুলের ছাত্রী সাদিয়া (৭) কে কোলে নিয়ে এক যুবক হেঁটে যাচ্ছিল। এ সময় সাদিয়া চিৎকার শুরু করলে এক রিকশাওয়ালা যুবককে আটকায়। পরে স্কুলের এক শিক্ষক ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। তারা সাদিয়ার মা’কে খবর দিয়ে আনে। এবং যুবকটিকে চিনে কি না জানতে চাওয়া হয়। এ সময় সাদিয়ার মা বলেন না আমি তাকে চিনি না। পরে স্থানীয় লোকজন উত্তেজিত হয়ে তাকে গণপিটুনি দেয়। লাথি আর লাঠির আঘাতে এক সময় যুবকটি নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। এরপর কিছু লোক যুবকটিকে টেনে-হিঁচড়ে প্রায় ১০০ গজ দূরে ক্যানেলপাড়ে ফেলে রাখে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালে পাঠালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অপরদিকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পাইনাদী নতুন মহল্লার শাপলা চত্ত্বর এলাকায় ইতালি প্রবাসী বিল্লালের বাড়ির চারতলায় খাদিজার ফ্ল্যাটে রেশমা নামে এক নারী প্রবেশ করে তার নাতি নাদিমকে (৩) পুতুল দেয়। এতে পরিবারের লোকজনের সন্দেহ হলে বাড়িওয়ালাকে খবর দেয়া হয়। এ ঘটনায় ওই বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে পরে লোকজন। একপর্যায়ে উত্তেজিত লোকজন তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে পিএম-এর মোড়ে আল বালাগ স্কুলে আটকে রাখে। খবর পেয়ে পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করতে গেলে উত্তেজিত লোকজনের সঙ্গে আধা ঘণ্টাব্যাপী ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন এবং ওই নারীকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যা হাসপাতালে পাঠায়।
আহত নারী সাংবাদিকদের জানান, তার স্বামীর নাম সালমান মিয়া। তিনি ঢাকার কেরানীগঞ্জে ঝিলমিল হাসপাতালের পাশে ভাড়া থাকে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর শাহীন শাহ্‌ পারভেজ জানায়, নিহতের লাশ উদ্ধার করে মর্গে এবং আহত নারীকে খানপুর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিহত ও আহতের বিস্তারিত পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, ময়মনসিংহের ভালুকায় উপজেলার ধামশুর গ্রামে গতকাল দুপুরে ছেলেধরা সন্দেহে মালেকা খাতুন (৪০) নামে এক নারীকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। পরে আহত ওই নারীকে উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ভালুকা উপজেলার পাচগাঁও গ্রামের শাহ্‌ আলমের স্ত্রী মালেকা খাতুন ভালুকা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য যাওয়ার পথে ধামশুর সরকারি প্রাথমিক স্কুলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এ সময় স্থানীয় কতিপয় লোক তাকে ছেলেধরা সন্দেহে মারধর শুরু করে। পরে ভালুকা মডেল থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ভালুকা হাসপাতালে ভর্তি করে। ওই নারী স্থানীয় একটি মোটরসাইকেল কারখানায় বোয়া হিসেবে কাজ করত। আহত মালেকা খাতুন জানান, শনিবার সকালে সে অসুস্থবোধ করায় কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে ভালুকা হাসপতালে আসার সময় শরীরটা ক্লান্ত হয়ে যায়। স্থানীয় একটি স্কুলের সামনে বিশ্রাম নিলে আমার সাথে থাকা বাজারের ব্যাগ দেখে স্থানীয়রা মারধর শুরু করে।
ভালুকা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মাইন উদ্দিন জানান, ধামশুর গ্রামে ছেলেধরা সন্দেহে এক মহিলাকে গনধোলাই দেয়ার খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, ঢাকার কেরানীগঞ্জে ছেলেধরা গলাকাটা সন্দেহে গণপিটুনিতে ১ জন নিহত ও অপর ১ জন গুরুতর আহত হয়েছে। আহত ব্যক্তিকে গুরুতর আহত অবস্থায় মালঞ্চস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাদের নাম পরিচয় এখনো পুলিশ জানতে পারেনি। তাদের উভয়ের বয়স হবে আনুমানিক ২৮ ও ৩০ বছরের মধ্যে। কেরানীগঞ্জ কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মো. চুন্নু মিয়া জানান, শুক্রবার রাতে হযরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে অপরিচিত ওই দুই যুবক উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করছিল। এ সময় তাদের গতিবিধি স্থানীয় লোকজনের সন্দেহ হলে এলাকাবাসীরা ছেলেধরা গলাকাটা সন্দেহে তাদের গণপিটুনি দেয়। এতে তারা দুইজনেই গুরুতর আহত হয়। সংবাদ পেয়ে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। এ সময় হযরতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আয়নাল হোসেন আয়নালের উপস্থিতিতে আহত ওই দুই যুবককে উদ্ধার করা হয়। আহতদের চেয়ারম্যানের লোকজনের মাধ্যমে ১ জনকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও অপর ১ জনকে মালঞ্চস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সকালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ জন মারা যায়। আহত অপর যুবকটি গুরুতর অসুস্থ থাকায় এই মুহূর্তে সে কোনো কথা বলতে পারছে না। সে একটু সুস্থ হলে তার ও নিহত যুবকের নাম পরিচয় জানা সম্ভব হবে।
কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ওসি শাকের মোহাম্মাদ যোবায়ের জানান, হযরতপুরের রসুলপুর গ্রামের লোকজন গলাকাটা সন্দেহে অপরিচতি দুই যুবককে গণপিটুনি দেয়। এতে একজন মারা গেছে, অপর জন হাসপাতালে ভর্তি আছে। এ ব্যাপারে থানায় একটি মামলা হবে। তবে নিহত ও আহত যুবক ছেলেধরা কিনা সে বিষয়ে তদন্ত করে দেখা হবে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version