দিন যত যাচ্ছে, ততই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। রাজধানীর সরকারি-বেরসকারি হাসপাতালগুলোর কেবিন, ওয়ার্ড, বারান্দা—সব জায়গায়ই ডেঙ্গুরোগী-ভর্তি। চিকিৎসকরা বলছেন, অন্যান্য বছরের মতো তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, গায়ে র‌্যাশ ও বমি বমি দেখা যাচ্ছে না এবার ডেঙ্গু রোগীদের। কারণ ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। এখন ডেঙ্গু হলে সামান্য জ্বরেই রোগীর হার্ট, কিডনি ও ব্রেইন আক্রান্ত হচ্ছে। যে কারণে রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে অন্যান্য বছরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।  একইসঙ্গে রোগী দ্রুত শকে চলে যাওয়ারও আশঙ্কা বেড়েছে। এ কারণে এবার বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীরই মৃত্যু হয়েছে ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে’। এ কারণে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বলছেন, কেবল রোগীরা নন,  চিকিৎসকরা ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)-এর মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে শনিবার (২০ জুলাই) বৈঠক শেষে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও)-ও।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নতুন ভবনের চার, পাঁচ, ছয়তলায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। শুক্রবার (১৯ জুলাই) কেবল ভর্তিই ছিল ১০০ জন। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ছিল ২৮৬ জন। এরমধ্যে শুক্রবার ছাড়পত্র নিয়েছেন ৬৬ জন।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে শুক্রবার (১৯ জুলাই) পর্যন্ত সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা পাঁচ হাজার ৫৬৬ জন। যার মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন তিন হাজার ১৯ জন। আর মারা গেছেন পাঁচ জন। এর মধ্যে এপ্রিল ও জুনে দুইজন আর জুলাইতে একজন। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি এই হিসেবের চেয়ে অনেক বেশি।

কন্ট্রোল রুমের হিসাব থেকে জানা গেছে, ডেঙ্গু রোগে গত জানুয়ারিতে ৩৭ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৯ জন, মার্চে ১৭ জন, এপ্রিলে ৫৮ জন, মেতে ১৮৪ জন, জুনে এক হাজার ৭৭০ জন এবং চলতি মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন তিন হাজার ৫৩২ জন।

চিকিৎসকরা ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কের কথা বললেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন বারবার বলছেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।’

এদিকে শনিবার (২০ জুলাই) সাঈদ খোকনের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও জানিয়েছে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর অবস্থা উদ্বেগজনক। তবে সাঈদ খোকন ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আছে জানিয়ে বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি। তবু, আমাদের আশেপাশের অনেক দেশের তুলনায় আমরা ভালো অবস্থানে আছি। পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আছে।’

অথচ ডেঙ্গু রোগী ও তাদের স্বজনরা বলছেন, আতঙ্ক কিকেবল মৃত্যুতেই? এত এত মানুষের ভোগান্তি, চিকিৎসা খরচ কি আতঙ্কের বিষয় নয়? এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল দৌড়ানো কি ভোগান্তিতে পড়ে না? পরিবারের একজনের ডেঙ্গু হলে অন্য সদস্যদের জন্য আতঙ্কের বিষয় নয়?

ডেঙ্গু আতঙ্ক নিয়ে মেয়র সাঈদ খোকনের বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে রাজধানীর দনিয়া এলাকার বাসিন্দা প্রকৌশলী এস এম মনির হোসেন বলেন, ‘পরিবারের তিনজনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। যে পরিস্থিতি চারিদিকে দেখা যাচ্ছে, তাতে করে এটা মহামারির দিকে যাচ্ছে। সিটি করপোরেশন থেকে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি আগে।’

মনির হোসেন আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু যে হবে, প্রতিবছর হয়, সেটা তো জানা কথাই। তারপরও সিটি করপোরেশন কোনও ব্যবস্থা নেয় না কেন? মশা মারার ওষুধ তো কোনোদিন দিতে দেখলাম না! এমন কোনও কর্মী এলাকায় দেখিনি। আমাদের এলাকার প্রায় বাড়িতেই ডেঙ্গু রোগী রয়েছে।’

এই বিষয়ে ঢামেকের মেডিক্যাল অফিসার রাশেদুল হাসান বলেন, ‘ডেঙ্গু মহামারি চলছে। ঢামেক হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা নেই। শুধু ডেঙ্গু রোগীদের জন্য শিগগিরই জরুরি ভিত্তিতে ২০০ বেডের একটি ইউনিট প্রয়োজন।’

ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহতা নিয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর গ্রিন রোডে অবস্থিত গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজন অ্যান্ড হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার সাবিলা মরিয়াম বলেন, ‘যেসব নারী ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে (রক্তক্ষরণসহ জ্বর) আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মিনস্ট্রুয়াল ব্লিডিং অনেক বেশি হচ্ছে। এসব রোগী শকে চলে যান দ্রুত, তাদের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। এর ফলে রোগীরা আতঙ্কিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।’

এদিকে, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগ এখন তাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। এত রোগী যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে, সেটা তাদের ধারণায়ও ছিল না।’

কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক হাপসাতালের চিকিৎসক তানভীর আহমেদ বলেন, ‘যারা সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে রয়েছেনম তাদের বলবো, আমাদের সঙ্গে এসে বসে দেখুন, কেবল রোগী নয়, আমরাও আতঙ্কিত হচ্ছি।’ ডেঙ্গু নিয়ে অবহেলা না করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version