ছেলেধরা, ডাকাত, গরুচোর ও ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। নির্দোষ মানুষেরও প্রাণ যাচ্ছে এসব ঘটনায়। ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনায় গণপিটুনি দিয়ে সারাদেশে হত্যা করা হয়েছে ৮২৬ জনকে। ২০১৮ সালে সারা দেশে গণপিটুনিতে ৩৯ ও ২০১৭ সালে ৫০ জন লোক মারা গেলেও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই নিহত হয়েছেন ৩৬ জন। আর চলতি মাসের দুই সপ্তাহে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে ১১ জনকে। এসব ঘটনায় মারাত্বকভাবে আহত হয়েছেন আরও অর্ধশতাধিক। গণপিটুনির এসব ঘটনায় মানবাধিকারকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারহীনতায় আইনের প্রতি মানুষের যখন আস্থা কমে যায় তখন মানুষ নিজ হাতে আইন তুলে নেয়। তাই আস্থা বাড়িয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজ করে যেতে হবে।
ছোট বড় প্রত্যেকটি ঘটনার জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই গণপিটুনির মত অপরাধ থেকে মানুষ সরে আসবে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ি ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত মোট সাড়ে আট বছরে সারা দেশে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে ৮২৬ জনকে। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৩৪জন, ২০১২ সালে ১২৬জন, ২০১৩ সালে ১২৮জন, ২০১৪ সালে ১২৭ জন, ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। ওই বছর সারাদেশে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় ১৩৫ জনকে। এছাড়া ২০১৬ সালে ৫১ জন, ২০১৭ সালে ৫০ জন, ২০১৮ সালে ৩৯ জন ও জুন ২০১৯ পর্যন্ত গণপিটুনি দিয়ে ৩৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আসকের দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে আরও জানা গেছে, এই সাড়ে আট বছরে গণপিটুনির সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ঢাকা অঞ্চলে। এই সময়ে ঢাকা অঞ্চলে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৩৫০ জন। এর পরেই রয়েছে চট্টগ্রামের অবস্থান। এই সময়ে চট্টগ্রামে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৯৬ জন, খুলনায় ৯৫জন, রাজশাহীতে ৭৫ জন, বরিশালে ২৯জন, রংপুরে ২৩জন ও সিলেটে ২১জন।
২০১১ সালের ১৭ই জুলাই শবেবরাতের রাতে সাভারের আমিন বাজারের বড়দেশী গ্রামের কেবলারচরে বেড়াতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছিলেন কলেজপড়ুয়া ছয় বন্ধু। মাইকে ঘোষণা দিয়ে ডাকাত আখ্যায়িত করে তাদেরকে গণপিটুনি দেয়া হয় পবিত্র ওই রাতে। নৃশংস ওই ঘটনা সারা দেশবাসীকে মর্মাহত করেছিল। কিন্তু গণপিটুনির শিকার ওই কলেজ শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর আট বছর পরেও মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। মামলাটি এখনও সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে। শনিবার রাজধানীর বাড্ডায় সন্তানের ভর্তির খোঁজ নিতে আসা ৪০ বছর বয়সী এক নারীকে ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় বাড্ডা থানায় অজ্ঞাত পাঁচ শতাধিক ব্যাক্তিকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে। ঘটনাস্থল ভিডিও ফুটেজ নিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করেছেন। এদেরমধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গণপিটুনিতে অপরাধী ব্যক্তিদের পাশাপাশি অনেক সময় নিরপরাধী ব্যক্তিরা নিহত হন। ২০১৫ সালের ২৫শে আগস্ট পাবনায় অপহরণকারী সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় তিন ব্যক্তিকে। পরবর্তীতে জানা যায়, ওই তিনজনই ছিলেন ব্যবসায়ী। অপহরণকারী গুজব রটিয়ে একটি মহল তাদেরকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেছিল। ওই তিনজনই পেশায় ব্যবসায়ী ও একে অপরের আত্মীয়।
গণপিটুনির কিছু কিছু ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন সময়। ২০১৫ সালের ১০ই ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আটজনকে। স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল নিহতরা ওই এলাকায় ডাকাতি করছিল। হাতেনাতে ধরে ফেলায় তাদেরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তবে, ডাকাতির অভিযোগে এভাবে মানুষ পিটিয়ে মারা কতটুকু নৈতিক তা নিয়ে সেসময় প্রশ্ন তুলেছিলেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় হত্যাকান্ডের ঘটনাকেও গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এমনই একটি ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। এদিন রাজধানীর কাজিপাড়া এলাকায় তিন তরুণ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করে। তবে পরবর্তীতে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে, ওই এলাকায় কোনো গণপিটুনির ঘটনা ওইদিন ঘটেনি। তাছাড়া পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিহত তিন তরুণের শরীরে মোট ৫৪টি গুলির দাগ ছিলা।