নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। খুন,ধর্ষণ,মানবপাচার,মালয়েশিয়াসহ প্রতিবেশি দেশে পালানোর চেষ্টা, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়,অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার,চুরি ও ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা।  কোনও কোনও ক্যাম্পে অস্ত্রের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, চাকরি দেওয়ার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া,এমনকি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রও তৈরি করছে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ।

সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এসব বন্ধে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা একটা ভালনারেবল অবস্থায় রয়েছে। এজন্য এখানে নানা পক্ষ সুযোগ নিয়ে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টাও করছে। জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।’

পুলিশ সুপার আরও  বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই ইয়াবা আনার চেষ্টা করছে। তবে পরিমাণে তা কম। আগে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে লাখ লাখ পিসের চালান আনতো। সেখানে রোহিঙ্গারা এখন ৫ থেকে ২০ হাজার পিসের চালান হয়তো আনে। আমরা তাদের নিয়মিত নজরদারি ও গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালিয়ে আসছি।’

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতীয়তার সনদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। ক্যাম্প এলাকার মাঝিরা (দল নেতা) বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বেশি পাওয়ায় অন্যদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ নিয়ে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। কয়েকজন মাঝি এরইমধ্যে হতাহতের শিকারও হয়েছেন। এছাড়া, রোহিঙ্গারা অভ্যন্তরীণ বিরোধ, পারিবারিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে একে অন্যের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে একের পর এক খুনের ঘটনাও ঘটছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এবং মাদক চোরাচালানের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে।

প্রতিবেদনে আরও  বলা হয়, রোহিঙ্গা নারীদের অনেকেই ক্যাম্প এলাকায় অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে। মাদকপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়া ছাড়াও রোহিঙ্গারা বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানিতে বা অর্থের লোভে জঙ্গিবাদের বড় ধরনের উত্থান ঘটাতে পারে।

রোহিঙ্গারা বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিভিন্ন দল যেমন হিট পয়েন্ট বা আল ইয়াকিন ইত্যাদি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে হত্যা, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করছে। ভবিষ্যতে তারা আরও সংগঠিত হয়ে নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে পারে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে ৯৯০ জন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মোট ৪২৯টি মামলা হয়েছে। প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

ক্যাম্পের ভেতরে চাঁদাবাজি

সরেজমিনে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, ৩৪টি ক্যাম্পের প্রায় প্রত্যেকটিতেই দোকানপাট ও বাজার বসেছে। এসব দোকানপাট থেকে প্রতিদিন ২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। স্থানীয় মাঝি বা বাজারের ইজাদারদের মাধ্যমে এই চাঁদার ভাগ যায় সংশ্লিষ্ট ক্যাম্প ইনচার্জের কাছেও। এই চাঁদা তোলা নিয়ে এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য মাঝেমধ্যেই দুই পক্ষের সংঘর্ষ ঘটে। পুলিশের পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও এসব তথ্য উল্লেখ রয়েছে।

পুলিশের প্রতিবেদন বলছে, রোহিঙ্গাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অবৈধ বাজার গড়ে উঠেছে। এক নম্বর ক্যাম্প এলাকার পূর্ব কুতুপালং লম্বাশিয়ায় আনুমানিক ৩০০টি দোকান, ক্যাম্প-২ এর পশ্চিমে ৩০-৪০টি দোকান, ক্যাম্প-৫ এর মধুরছড়ায় ২০০-২৫০টি, ক্যাম্প-৬ এর কুতুপালংয়ে ১৫০-২০০টি, ক্যাম্প-৭ এর কুতুপালং টিভি সেন্টারে ৭০-৮০টি, ক্যাম্প-৮ এর পূর্ব বালুখালীতে ১৫০-২০০টি, ক্যাম্প-৯ এর বালুখালীতে ৪০০টি, ক্যাম্প-১১ এর বালুখালী ২/২ তে ২০০-২৫০টি, ক্যাম্প-১২ এর বালুখালী-ময়নারঘোনায় ১৫০-২০০টি, ক্যাম্প-১৩ এর তাজমিনার খোলায় ১০০-১৫০টি, ক্যাম্প-১৪ এর হাকিমপাড়ায় ১০০-১২০টি, ক্যাম্প-১৬ এর জামতলীতে ৮০-১০০টি, ক্যাম্প-১৭ ইরানি পাহাড়ে ৫০-৬০টি দোকান রয়েছে। এসব বাজারে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, দোকানের ভাড়া আদায় এবং দখলকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হয়েছে।

মাদক ব্যবসায় রোহিঙ্গারা

পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মাদকবিরোধী অভিযান জোরদারের পর থেকে টেকনাফ ও উখিয়া এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কিছুটা ভীতি কাজ করলেও ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়ছে ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা। সাধারণ ক্যাম্পের ভেতরে পুলিশি অভিযান চালানো কঠিন হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। এছাড়া, স্থানীয় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অনেকেই ইয়াবার চালান সংগ্রহ করে ক্যাম্পের ভেতরে মজুত করে রাখে।

পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার ১১টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা নিয়মিত মিয়ানমারে যাতায়াত করে। এসব সীমান্ত পয়েন্টগুলো হলো— উখিয়ার আঞ্জুমান পাড়া, রহমতের বিল, দামনখালী, হাতিমুড়া, দরগাহ বিল, আজুখাইয়া ও তম্ব্রু সীমান্ত। এছাড়া, টেকনাফের জাদিমুড়া, উনচিপ্রাং, হোয়াইক্যং ও হ্নীলা সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা যাতায়াত করে থাকে।

মানবপাচার ও অপহরণের ঘটনাও ঘটছে

রোহিঙ্গা ক্যাম্প, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিষ্ঠান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ‘ভালনারেবল’। মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর নাম করে এক শ্রেণির দালাল তাদের পাচার করার চেষ্টা করছে। এছাড়া, রোহিঙ্গা তরুণীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি করানোর অভিযোগও রয়েছে। পুলিশ বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গারা আসার পর প্রথম দিকে মানবপাচারের প্রবণতা ছিল না। কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় এটি। ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে এবছরের জুলাই পর্যন্ত মানবপাচার সংক্রান্ত ২৩টি মামলা হয়েছে। সম্প্রতি আরেকটি মামলাসহ মোট ২৪টি মামলায় ১০২ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ৫৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ৪৪৯ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘবদ্ধ একাধিক সন্ত্রাসী দল গড়ে উঠেছে। ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা পরিবারের যেসব সদস্য মালয়েশিয়া, সৌদিআরব বা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে চাকরি করেন, প্রথমে তাদের বিষয়ে তথ্য যোগাড় করে সন্ত্রাসীরা। এরপর তাদের পরিবারের সদস্যদের অপহরণ ও আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। ১০ হাজার থেকে লাখ টাকাও আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ হিসেবে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version