হাজার তিনেক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরানোর একটি উদ্যোগ ছিল ২২ আগস্ট। বাংলাদেশে এই শরণার্থীদের যে ঢল নেমেছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট, তার ঠিক দুই বছর পর। সে সময় এক ধাক্কাতেই প্রায় সাড়ে ৭ লাখ শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা সবাই জানি শরণার্থীদের ফেরানোর উদ্যোগ সফল হয়নি। একজন শরণার্থীও ফিরে যায়নি। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে, কারা আশা করেছিলেন যে শরণার্থীরা ফিরে যাবে? যাঁরা আশাবাদী ছিলেন, তাঁদের বুদ্ধি-বিবেচনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কি খুব অযৌক্তিক হবে?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, রোহিঙ্গাদের না ফেরার দায় মিয়ানমারের। বেশ গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও আবিষ্কার! যে দেশ একটি জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন ও গণহত্যা চালিয়ে তাদের দেশছাড়া করেছে, তারা এমনি এমনি সেই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবে—এমন আশা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করেছিল কী করে! তার চেয়েও বড় কথা, শরণার্থীরা কেউ ফিরে যেতে চায়নি। বাংলাদেশের যারা আশা করেছিলেন ২২ আগস্ট শরণার্থীদের ফেরা শুরু হবে এবং তা না হওয়ায় হতাশ হয়েছেন, তাঁরা আসলে বোকার স্বর্গেই আছেন।
মিয়ানমারের অনেক দিনের ‘স্বপ্ন’ রাখাইন রাজ্যটিকে রোহিঙ্গাশূন্য করা এবং সে পরিকল্পনায় তারা অনেকটা এগিয়ে গেছে। ফলে বাধ্য না হলে দেশটির রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে তার দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির কাজটি করতে পারেনি। বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত যা করেছে তা হচ্ছে, মিয়ানমারের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তি। এই চুক্তির কোনো আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি নেই, তৃতীয় কোনো দেশ বা পক্ষের আনুষ্ঠানিক যুক্ততাও নেই। এমন একটি চুক্তির ফলাফল যা হওয়ার কথা, তা–ই হয়েছে।
শরণার্থীরা যে পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়ে, তাতে তাদের ফিরে যেতে বাধ্য করা যায় না। এর সঙ্গে তাদের জীবনের নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যে চুক্তি করেছে, সেখানেও খুব স্বাভাবিকভাবেই শরণার্থীদের ‘স্বেচ্ছায়’ ফিরে যাওয়ার বিষয়টি রয়েছে। বাংলাদেশ শরণার্থীদের যে তালিকা দিয়েছিল, তা থেকে মিয়ানমার মাত্র ৩ হাজার ৪৫০ জনকে ফিরিয়ে নেওয়ার সবুজ সংকেত দিয়েছিল। এদের একজনও ফিরে যেতে রাজি হয়নি। এ জন্য মিয়ানমারকে নতুন করে কিছুই করতে হয়নি। তারা আগে যা করেছে, সেটাই যথেষ্ট। যে অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা বাংলাদেশে এসেছে, তারপর কোন ভরসায় তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে! ফিরে যাওয়ার পর তাদের জীবন নিরাপদ থাকবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা তাদের কেউ দিতে পারছে না। কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা বা গোষ্ঠী সেই দায় নেয়নি। ফেরার পর তারা তাদের জমিজমা ও সম্পদ ফেরত পাবে—এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও নেই। রোহিঙ্গারা কোন ভরসায় ও কিসের আসায় ফিরে যাবে?
রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি না হওয়ায় বাংলাদেশের নাগরিকদের অনেকেই খেপেছেন। ফেসবুকে তা টের পাওয়া যায়। বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা বেশ ‘আদর-যত্নে’ বা ‘সুখে’ আছে, তাই তারা ফেরত যাচ্ছে না—এমন কথাগুলো বড়ই নিষ্ঠুর। সাধারণ মানুষের এমন মন্তব্যকে আপনি না হয় পাত্তা দিলেন না, কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল কারও একই ধরনের মনোভাব ও মন্তব্যকে উপেক্ষা করা যায় কি? খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের শিকার বিপন্ন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে। বাংলাদেশ তার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে তাদের আশ্রয়, খাবারের জোগান ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু শরণার্থীজীবন কখনো ‘আরাম-আয়েশ’ বা ‘সুখের’ হতে পারে কি? যারা শরণার্থীশিবিরগুলোতে গিয়েছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা কি তা–ই বলে? বাংলাদেশে শরণার্থীশিবিরগুলোতে তারা যেভাবেই থাকুক না কেন, এখানে অন্তত বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা আছে, কিন্তু ফিরে গেলে তা না–ও থাকতে পারে। ফিরে যাওয়া নিয়ে তাই তাদের এত ভয়।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যে ঢল নেমেছিল ২০১৭ সালে, তার দুই বছর পূর্তিতে ২৫ আগস্ট কক্সবাজারের উখিয়ায় এক বড় সমাবেশ করেছে শরণার্থীরা। সেখানে তারা বলেছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের আগে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, তারপর তারা ফিরে যাবে। এ নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় বসতেও চেয়েছে তারা। এসব চাওয়াকে অযৌক্তিক বলা যায় না। তারা যদি মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই স্বীকৃতি না পায়, তবে কোন ভরসায় তারা ফিরবে? নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না দিয়ে মিয়ানমার যুগের পর যুগ ধরে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার–নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে। ফিরে যাওয়ার আগে নাগরিকত্ব ইস্যুর নিষ্পত্তি রোহিঙ্গারা চাইতেই পারে।
শরণার্থীদের ফেরাতে মিয়ানমারের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ, তা যে কোনো ফল দেবে না, তা পরিষ্কার। একমাত্র আন্তর্জাতিক চাপই রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার পথ তৈরি করতে পারে। রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহা করতে মিয়ানমারকে বাধ্য করা গেলেই তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ কাজে দেবে। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গঠন করে ফিরে যাওয়া শরণার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে এটা কোনো সহজ কাজ নয়।
সবকিছুরই একটা মোমেন্টাম বা মাহেন্দ্রক্ষণ থাকে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সেই ক্ষণটি হারিয়েছে। দুই বছর আগে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামার পর বিশ্বসম্প্রদায়ের মনোযোগের কেন্দ্রে জায়গা করে নিয়েছিল রোহিঙ্গা সংকট। পরের মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনের অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল রোহিঙ্গা পরিস্থিতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই অধিবেশনে এই সংকট সমাধানে যে পাঁচ দফা প্রস্তাব রেখেছিলেন, সেটাই ছিল বাস্তবসম্মত পথ। বাংলাদেশের উচিত ছিল সেই প্রস্তাবগুলো ধরে বিশ্বসম্প্রদায়কে নিয়ে এগোনো। কিন্তু বাংলাদেশ সেখানে স্থির থাকতে পারেনি। রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ‘সেফ জোন’ গঠন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি শর্ত ছাড়াই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। এই চুক্তির ফলাফল কী, তা আমরা এখন দেখছি। তবে এই চুক্তি সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি করেছে তা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মনোযোগ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুকে অনেকটাই সরিয়ে দিতে পেরেছে।
সব মিলিয়ে ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপ বাংলাদেশের পক্ষে দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়। চাপটি শুধু অর্থনৈতিক নয়। এর সামাজিক, পরিবেশগত, আইনশৃঙ্খলা ও ভূরাজনৈতিক বিপদও যথেষ্ট গুরুতর। এসবের কিছু আলামত এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতেই হবে। এই সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে নতুন পথ খুঁজতে হবে। রাখাইন রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছে কি না, তা দেখতে বিভিন্ন দেশের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের কথা সরকার ভাবছে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন। বর্তমান চুক্তি বজায় রেখে এটা কীভাবে সম্ভব বা মিয়ানমার এ ধরনের প্রস্তাবে রাজি হবে কি না, তা এক বড় প্রশ্ন। এমন কিছু কার্যকর করতে হলে জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির পথ ধরতে হবে।
দুই বছর আগে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিয়ানমারের ওপর যত সহজে চাপ তৈরি করা যেত, এখন হয়তো তা হবে না। আগামী মাসে (সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশন বসছে, বাংলাদেশ এই উপলক্ষকে কাজে লাগাতে পারে। রোহিঙ্গা সংকটকে আবার বিশ্বজনমত ও পশ্চিমা দেশগুলোর মনোযোগের কেন্দ্রে আনতে হবে। অন্যদিকে, মিয়ানমারের ওপর কোন দেশগুলোর প্রভাব রয়েছে বা কোন দেশগুলোর চাপ কাজে দেবে, তা বাংলাদেশের অজানা নয়। যে তিনটি দেশ এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, চীন, ভারত ও জাপান। এই দেশগুলো শুধু বাংলাদেশের বন্ধু নয়, বরং ‘ঘনিষ্ঠ’ বন্ধু হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই তিনটি দেশ বরং মিয়ানমারের দিকেই হেলে আছে। এটা যদি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা হয়ে থাকে, তবে সেই ব্যর্থতা দূর করতে এখনই গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে।