চাঁদাবাজি, টেন্ডার ও ক্যাসিনোকাণ্ডে ‘লণ্ডভণ্ড’ হয়ে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো। চরম আতঙ্ক ও অস্থিরতা বিরাজ করছে সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে। প্রভাবশালী সংগঠন যুবলীগের আগামী কংগ্রেসে বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়ায় ক্ষুব্ধ ছিটকে পড়া নেতারা। অন্য দিকে পদ হারানো কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদ না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের অব্যাহতিপ্রাপ্ত দুই শীর্ষ নেতার অনুসারীরা। নিজ সংগঠনের মধ্যেই চাপের মুখে রয়েছেন ছাত্রলীগের অব্যাহতি পাওয়া শীর্ষ দুই নেতার কর্মীরা।

বিতর্কিত ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি প্রভাবশালী সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের চেয়ারম্যান ও সভাপতিকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদককে। অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতাকে। এ ছাড়া গ্রেফতার করা হয়েছে সংগঠনগুলোর প্রভাবশালী একাধিক নেতাকে। গ্রেফতারের তালিকায় রয়েছেন আরো অনেকে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে, বর্তমানে সাতটি সহযোগী ও তিনটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে। সহযোগী সংগঠনগুলো হচ্ছে : মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতী লীগ ও যুব মহিলা লীগ। ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগকে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের স্বীকৃতি দেয়া আছে গঠনতন্ত্রে। এ ছাড়া গঠনতন্ত্রে স্বীকৃতি না থাকলেও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদকেও (স্বাচিপ) বর্তমানে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মর্যাদা দেয়া হয়।

জানা গেছে, নেতাদের পদ আঁকড়ে রাখার প্রবণতার কারণে দীর্ঘ দিন ধরে অনেক সহযোগী সংগঠনেরই সম্মেলন হয় না। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এসব সংগঠনের অনেক নেতাই বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছেন। অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় আলাদা রাজত্ব কায়েম করেছেন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক, জুয়া ও অবৈধ ক্যাসিনোতে জড়িয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন অনেকে। বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন কেউ কেউ। বিষয়টি নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগসহ দলের মাঠপর্যায়ে নানা গুঞ্জন ও সমালোচনা ছিল। বিভিন্ন সময়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও আওয়ামী লীগ ও সরকারের শীর্ষ মহলকে এসব বিষয়ে অবহিত করা হয়। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সদ্যসাবেক দুই শীর্ষ নেতার চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাদের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে উঠে আসে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ থেকে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠার পর গত ১৪ সেপ্টেম্বর তাদের অব্যাহতি দিয়ে পরবর্তী দুইজনকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেন সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই তিনি যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল চৌধুরী স¤্রাট ও সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে ব্যবস্থার নির্দেশ দেন। খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতারের পরপরই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ক্যাসিনো ব্যবসার খবর বেরিয়ে আসে।

রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে অভিযানের পাশাপাশি একে একে যুবলীগ নেতা জি কে শামীম, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিকুল ইসলাম ফিরোজ, যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী স¤্রাটকে গ্রেফতার করা হয়। রিমান্ডে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নানা অভিযোগের মুখে ইতোমধ্যে যুবলীগের প্রভাবশালী চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তার পরিবারের সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে বিদেশ যাত্রার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুন্নবী শাওনের বিদেশ যাত্রার ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বহিষ্কার করা হয়েছে যুবলীগের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও ঢাকা দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ কাউন্সিলরকে। গত বুধবার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মোল্লা আবু কাউছারকে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে দায়িত্ব থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথকে।
এ দিকে চলমান শুদ্ধি অভিযানের মুখে সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে।

আগামী ২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসে ৫৫ বছর বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ছিটকে পড়েছেন প্রভাবশালী নেতারা। অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নেতারা বেশ উৎফুল্ল হলেও এ নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন সিনিয়ররা। আর অব্যাহতি প্রাপ্ত প্রভাবশালী চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর অনুসারীরা রয়েছেন পদ হারানোর আতঙ্কে।

১৬ নভেম্বর স্বেচ্ছাসেবক লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সম্মেলনে অব্যাহতি পাওয়া মোল্লা আবু কাউছার ও পঙ্কজ দেবনাথের অনুসারীরা ছিটকে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। আর চরম কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন ছাত্রলীগের শোভন ও রাব্বানীর অনুসারীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনটি সংগঠনের একাধিক নেতা তাদের এমন দুরবস্থার কথা জানিয়েছেন। বয়সের কারণে বাদ পড়া যুবলীগের তিন প্রেসিডিয়াম সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওমর ফারুক চৌধুরীর স্বেচ্ছাচারিতা ও অপকর্মের কারণে আমাদের কপাল পুড়ল। এখন আর কিছুই করার নেই।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, চলমান শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। সে জন্য পদ থেকে অপসারণের পাশাপাশি প্রভাবশালী আরো অনেক নেতাকেও গ্রেফতার করা হতে পারে। আর বিতর্কিতদের সহযোগীরা দলে কোণঠাসা থাকবে এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version