লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। ইতিহাস নির্ভর তার বেশ কিছু বই এরই মধ্যে বিপুল আলোচিত। তার নতুন বই, ‘৩২ নম্বর পাশের বাড়ি: ২৫ মার্চ ১৫ আগস্ট’। বাতিঘর কর্তৃক প্রকাশিত এই বইতে  বঙ্গবন্ধুর খুনি ক্যাপ্টেন বজলুল হুদার প্রসঙ্গ এসেছে। এতে বলা হয়েছে, হুদার কলেজ জীবনের বন্ধুদের একজন ছিলেন আবদুল বাতেন চৌধুরী। বাতেনের বাড়ি কুমিল্লা জেলার লাকসামে। তিনি মুহসীন হলের ৩-এ নম্বর কামরায় থাকতেন। তিনি ছিলেন জাসদের ঢাকা নগর পার্টি ফোরামের সদস্য।

হুদা বাতেনের রাজনৈতিক পরিচয় সম্বন্ধে জানতেন। বাতেন স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগ করতেন এবং ১৯৭২-৭৩ সালে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

২০১৪ সালে জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি নামে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি লেখার উপাদান সংগ্রহের জন্য আমি অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাদের একজন হলেন বাতেন। সাক্ষাৎকারে তিনি হুদা প্রসঙ্গে যা যা বলেছিলেন, এখানে তা উদ্ধৃত করা হলো:
পঁচাত্তরের ১৩ আগস্ট বিকেল তিনটায় সেনা গোয়েন্দা দপ্তরের (ডিএমআই) ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা অসামরিক পোশাকে মুহসীন হলে আমার কামরায় এল। সে ছিল ঢাকা শহরের দায়িত্বে। আমরা সূর্যসেন হলের ক্যান্টিনে গিয়ে চা খেলাম। তারপর রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে একটা গাছের নিচে ঘাসের উপর বসলাম। শুরু হলো কথাবার্তা।

হুদা: তোরা যেভাবে চেষ্টা করছিস তাতে কিছু হবে না। লেট আস ইউনাইটেড অ্যান্ড গিভ হিম আ ব্লো।
বাতেন: ইউনাইটেড হতে পারি, কিন্তু ব্লো দিতে পারব না। আমরা বিপ্লবে বিশ্বাস করি। তুমি যা বলছ, সে পথ আমাদের নয়।
এভাবে কিছুক্ষণ কথা বলার পর সন্ধ্যা হয়ে এল। আমরা দুজন বলাকা বিল্ডিংয়ের দোতলায় একটা চায়নিজ রেস্তোরাঁয় খাবার খেলাম। হুদা চলে যাওয়ার সময় আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, ‘কাল-পরশু দুদিন হলে না থাকাই ভালো। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। নানা ধরনের চাপ থাকবে। রাতে বাইরে থাকিস।’ সে যোগাযোগের জন্য আমাকে একটা টেলিফোন নম্বর দিল।
আমি সে রাতে মুহসীন হলেই ছিলাম। পরদিন ১৪ আগস্ট আমি আজিমপুর কলোনিতে আমার বোনের বাসায় যাই এবং সেখানে রাত কাটাই।

১৫ আগস্ট সকালে ঘুম ভাঙতেই রেডিওতে অভ্যুত্থানের সংবাদ পাই। আমি বোনের বাসা থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে নিউমার্কেটে আসি। নীলক্ষেতের মোড়ে বিউটি রেস্টুরেন্টে যাই এবং সেখানে নাস্তা করি। তারপর মুহসীন হলের দিকে রওনা হতেই দেখলাম, বেশ কয়েকজন ছাত্র উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। তারা খুবই-সন্ত্রস্ত। আমি এদের মধ্যে ফকির গোলেদার রহমানকে দেখলাম। গোলেদার সাইকোলজির ছাত্র এবং মুজিববাদী ছাত্রলীগের নেতা। তার পরনে লুঙ্গি এবং গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। সে বলল, সে হলের গ্রিলবিহীন জানালা দিয়ে হল অফিসের একতলার ছাদে লাফিয়ে নেমেছে এবং এখন যতদূর সম্ভব চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। আমাকে সে বলল, ‘দোস্ত, আমারে মাপ কইরা দিস।’

আমি হলে আমার কামরায় গেলাম। সেখানে জাহাঙ্গীর আর রুবেলকে পেলাম। ওরা দুজনই মুজিববাদী ছাত্রলীগের কর্মী। আমার রুমমেট। বললাম, ‘তোরা আমার বোনের বাসায় চলে যা।’ আমি নিজেই তাদের আজিমপুর আমার বোনের বাসায় নিয়ে এলাম।’
বেলা ১১টার দিকে বজলুল হুদা আমার বোনের বাসায় এসে হাজির। সে আমাকে নিয়ে বের হলো। সে নিজেই একটা জিপ চালাচ্ছিল। জিপের পেছনে একটা পিকআপে কয়েকজন সিপাহি। হুদা বলল, ‘জাসদের সাপোর্ট দরকার। এটা ব্যবস্থা করো।’ আমি বললা, ‘জাসদ সাপোর্ট দেবে না। জাতীয় ঐক্যের চেষ্টা করো। তাজউদ্দীনকে আনো, রাজ্জাককে আনো।’

হুদা আমাকে নিয়ে গণভবনের পেছনে একটা সেনা ক্যাম্পে এল। সেখানে একটা ক্যান্টিনে আমরা পরোটা-মাংস খেলাম। তারপর আমাকে আসাদ গেটের কাছে নামিয়ে দিয়ে সে তাজউদ্দীনের বাসার দিকে রওনা হলো। সে পরে তাজউদ্দীনের বাসায় তার অভিজ্ঞতার কথা আমাকে বলেছিল। তাজউদ্দীনকে হুদা সরকার গঠনের অনুরোধ জানালে তাজউদ্দীন জবাবে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে আমি প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট হতে চাই না।’

হুদা আমাকে মুজিব হত্যার বিবরণ দিয়েছিল। তার ভাষ্যমতে, ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাড়িতে আমরা আক্রমন চালাই মেজর (অব.) নূরের নেতৃত্বে। গোলাগুলির শব্দ শুনে কামাল বেরিয়ে আসে। কামাল প্রথমে গুলি ছোড়ে। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে গুলি করে হত্যা করি। গোলাগুলির শব্দ শুনে শেখ মুজিব ওপর থেকে চিৎকার করে আমাদের গোলাগুলি থামাতে বলেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কোনো কিছু বলার থাকলে ওপরে এসে আমাকে বলো।’ তখন আমরা দোতলায় উঠি। শেখ মুজিবকে দেখে আমি স্যালুট দেই। রাষ্ট্রপতিকে সামনা সামনি দেখে ভয়ে ও উত্তেজনায় আমার পা কাঁপছিল। সাহস সঞ্চয় করে বলি, ‘আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।’ শেখ মুজিব রেগে গিয়ে বলেন, ‘কোথায় যাবো, কেন যাব, না, আমি যাবো না।’ আমি সাহস করে বলি, ‘আপনাকে যেতেই হবে।’ আমি তাঁর গলার কাছে রিভলবারের নল ঠেকাই। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি একটু চেঞ্জ করে আসি।’ তার পরনে লুঙ্গি।

আমি সময় নষ্ট করতে চাইনি। বললাম, ‘এ পোশাকেও আপনি বঙ্গবন্ধু’ চেঞ্জ করলেও বঙ্গবন্ধুই থাকবেন। পোশাক বদলানোর দরকার নেই।’ তিনি আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন। বললেন, ‘দাঁড়াও, আমার পাইপ আর তামাক নিয়ে আসি।’ এই বলে তিনি তাঁর ঘরে গেলেন এবং পাইপ নিয়ে বেরিয়ে এলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছালে পেছন থেকে একজন একটা গামছা বের করে তাঁর চোখ বাঁধতে যায়। তিনি এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দেন। হাতের আঘাত থেকে বাঁচতে আমি হাঁটু মুড়ে বসে পড়ি। তখন আমার পেছন থেকে তাঁর ওপর ব্রাশফায়ার করা হয়। তিনি তখনই মারা যান। অন্যরা এসময় দোতলায় গিয়ে বাড়ির অন্যদের হত্যা করে।

আমি হুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা তাঁকে কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে? হুদা বলেছিল, রেডিও স্টেশনে। সেখানে তাঁকে এনাউন্সমেন্ট দিতে হতো-বাকশাল বাতিল করা হয়েছে, খন্দকার মোশতাককে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে। হুদা আরও বলেছিল, আমি জানতাম না, তাঁকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা হয়েছিল। আমার অ্যাসইনমেন্ট ছিল, তাঁকে ধরে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যাওয়া। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমরাতো তাকে পেয়েছিলেই, অন্যদের মারতে গেলে কেন?’ হুদার জবাব ছিল, শেখ মুজিবকে মেরে ফেলার পর আমরা আর কোনো সাক্ষী রাখতে চাইনি।’

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version