প্রায় দেড় যুগ পর ব্যাংক রেট কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারের অগ্রাধিকার খাত বাস্তবায়ন সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী কমিটি ব্যাংক রেট এক শতাংশ কমিয়ে ৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার সুপারিশ করেছে। এর পর থেকেই ব্যাংক রেট কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সর্বশেষ ব্যাংক রেট কমানো হয়েছিল ২০০৩ সালে। ব্যাংক রেট কমলে বিনিয়োগকারীদের কম সুদে বিনিয়োগ পেতে সহায়তা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, নানা উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। বরং দিন দিন কমে যাচ্ছে। দেশের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি কম। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যেখানে আগের অর্থবছরে এ খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ। বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে তাই বিনিয়োগ ব্যয় কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।

জানা গেছে, কোনো দেশের মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে যে উপকরণগুলো ব্যবহার করা হয়, তার অন্যতম হলো ব্যাংক রেট। বাংলাদেশ ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংককে ঋণ দেয় সেটাই ব্যাংক রেট। ব্যাংক রেট বাড়ালে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ দান মতা কমে। বাজারে মুদ্রার সরবরাহও কমে যায়। আবার রেট কমালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদান মতা বাড়ে। তখন বাজারে মুদ্রার সরবরাহও বাড়ে। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক রেট কমলে গ্রাহকপর্যায়ে ঋণের সুদহার আরও কমবে। এতে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। কারণ ব্যাংক রেট যেটুকু কমানো হবে, সেই রেটে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল পাবে। ফলে এসব ঋণের গ্রাহক আগের চেয়ে কম সুদে ঋণ পাবেন। এ ছাড়া ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ব্যাংক রেটের হিসাবে আগের চেয়ে কম সুদে ঋণ পাবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে ব্যাংক রেটের ব্যবহার সেভাবে হয় না। নীতিনির্ধারণী রেপো ও রিভার্স রেপো চালুর পর থেকে অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে ব্যাংক রেট। বর্তমানে ব্যাংক রেট বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব ও দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নে পরিচালিত সব পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের তহবিলে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত পুনঃঅর্থায়নের স্কিমগুলোর অর্থ ব্যাংক রেটে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ওই রেটের সাথে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বাড়তি সুদে গ্রাহকপর্যায়ে এ ঋণ বিতরণ করে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতি বছর যে পরিমাণ কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়, সেখানেও ব্যাংক রেট কার্যকর। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ব্যাংক রেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কৃষিঋণের তহবিল পেয়ে থাকে। এ ছাড়া ব্যাংকের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাংক রেটের ঋণসুবিধা পান।

কৃষি, এসএমইসহ সরকারের অগ্রাধিকার খাতগুলোতে কম সুদে গ্রাহকের মধ্যে ঋণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে নীতিনির্ধারণী কমিটি। ওই কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতেই ব্যাংক রেট কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কমিটির মতামতের ওপর বিভিন্ন বিভাগের মতামত নেয়া হয়েছে। এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, ব্যাংক রেট সর্বশেষ কমানো হয় ২০০৩ সালের ৬ নভেম্বর। ওই সময় ৬ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এর আগে ১৯৮৯ সালে ব্যাংক রেট ছিল সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা ১৯৯১ সালের ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। তবে বিনিয়োগ ব্যয় কমাতে ১৯৯১ সালের ১৭ নভেম্বর তা দশমিক ২৫ শতাংশ কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ, ১৯৯২ সালের ১৫ মার্চ ৯ শতাংশ, একই বছরের ৩ জুন ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ, ১৯৯৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ৮ শতাংশ, একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ৭ শতাংশ এবং ২৪ এপ্রিল তা সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। ১৯৯৪ সালের ২ মার্চ পর্যন্ত এ হার অপরিবর্তিত থাকে এবং ৩ মার্চ তা কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়; যা ১৯৯৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। তবে একই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ব্যাংক রেট আবার বৃদ্ধি করে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং ৭ অক্টোবর থেকে ৬ শতাংশে উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ব্যাংক রেট আরও বৃদ্ধি করে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়; যা ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। ১৯৯৬ সালের ৩১ অক্টোবর ব্যাংক রেট আরও বাড়িয়ে ৭ শতাংশ এবং ১৯ মে সাড়ে ৭ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়, যা ১৯৯৮ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। একই বছরের ২৪ নভেম্বর ব্যাংক রেট ৮ শতাংশ করা হয়; যা ২০০০ সালের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। তবে ২৯ আগস্ট ব্যাংক রেট আবার কমিয়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়; যা ২০০২ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে। একই বছরের ২৪ অক্টোবর ব্যাংক রেট কমিয়ে ৬ শতাংশ এবং নভেম্বরে আরও কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়, যা এখনো বিদ্যমান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাধারণত ব্যাংক রেট পরিবর্তন তথা হ্রাস-বৃদ্ধি করেও বাজারে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ব্যাংক রেট কমলে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বাড়ে। তখন মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে। মূল্যস্ফীতি নি¤œমুখী থাকলে সব ধরনের সুদের হারই কমতির দিকে থাকে। এটাই জগতের নিয়ম। বর্তমানে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি নি¤œমুখী রয়েছে। তবে ব্যাংক রেট পরিবর্তন হলে সার্বিক অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, সেটি পর্যালোচনা করার পর বলা যাবে।

জানা গেছে, বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটাতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয। কিন্তু কোনোভাবেই এর ধারে কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। এ দিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী সুদ রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদহারও বছর দুই আগে কমানো হয়েছে। বর্তমানে কলমানি সুদও ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। পাশাপাশি জানুয়ারি শেষে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির হার নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশে। এ ছাড়া সব ব্যাংকের আমানতের সুদহার ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। সব মিলে ব্যাংক রেট কমানোর সহায়ক পরিবেশ রয়েছে। এ কারণেই ব্যাংক রেট কমানোর ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version