নারী বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা মেশিনের সন্ধান পেয়েছিলেন শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। টাকার জোরেই নরসিংদী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। অল্প দিনেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। দেশে-বিদেশে গড়েছেন বিপুল সম্পদ। রিমান্ডে থাকা পাপিয়া ইতিমধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন গোয়েন্দাদের। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট  রয়েছে বলে তিনি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, তিনি দেশে অবৈধভাবে টাকা উপার্জন করে বিদেশে পাচার করেছেন। থাইল্যান্ড ছাড়া আর কোন দেশে তার টাকা রয়েছে তা খতিয়ে দেখছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।

এদিকে পাঁচতারকা হোটেলে গড়ে তোলা পাপিয়ার অপরাধের ডেরায় কারা যেতেন তারও তথ্য আসছে জিজ্ঞাসাবাদে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসহ নানা পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল সেখানে। সেখানে যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া অস্ত্র ব্যবসা নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টদের। তার অপকর্মের দুই সহযোগী রাকিব ও সুমন সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে অস্ত্র দেশে আনতেন। এরপর এসব অস্ত্র তারা ঢাকায় ডিলারদের কাছে পৌঁছে দিতেন। ঢাকার একাধিক অস্ত্রের ডিলারের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে রিভলভার, একে-২২ ও কাটা রাইফেল নিয়ে এসে ঢাকার ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করতো তার সহযোগীরা। পুরো বিষয়টি দেখভাল করতেন পাপিয়া। সিলেটের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরেই অস্ত্র ব্যবসায় জড়িয়েছেন পাপিয়া। ইতিমধ্যে ওই ব্যবসায়ীর নাম জানতে পেরেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। পাপিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পরই তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাকে খুঁজছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সেইসঙ্গে পাপিয়ার সহযোগী সুমন ও রাকিবকে খুঁজছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়াও পাপিয়ার অপকর্মের সহযোগী এই সুমন কক্সবাজার থেকে ইয়াবা ঢাকায় নিয়ে আসতেন। সরবরাহ করা হতো ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে। এসব ইয়াবা বিভিন্ন তারকার হোটেলে সরবরাহ করা হতো।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার থেকে ইয়াবারা বড় চালান ঢাকায় আনতেন পাপিপা। এক্ষেত্রে তিনি কুরিয়ার সার্ভিসকে বেশি ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও মাদক সরবরাহে বড় পথ ছিল তার ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। তদন্তকারীরা  জানায়, এছাড়াও বিদেশি জাল টাকা তৈরি করা ছিল তার এক প্রকারের নেশা। একবার বসুন্ধরা শপিংমলে বিদেশি জাল মুদ্রা ভাঙ্গাতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েছিলেন। সে যাত্রায় তিনি রক্ষা পান।
পাপিয়ার মামলাটি র‌্যাবের পাশপাশি ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশও ছায়া তদন্ত শুরু করেছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পাপিয়া বিমানবন্দর থানায় ছিলেন। তাকে গত রাতে শেরে বাংলানগর থানায় নেয়ার কথা ছিল।
গতকাল পাপিয়াকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবদ করছে পুলিশ। বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক কায়কোবাদ কাজী জানান, পাপিয়া রিমান্ডে আছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।  এদিকে, র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল মানবজমিনকে জানান, পাপিয়া র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিদেশে  টাকা পাচার করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। তার থাইল্যান্ডের ব্যাংককের একাধিক ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে । বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। তিনি আরও বলেন, মাদক ও অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে সে অর্থ আয় করেছে। আমরা তার তথ্যের সূত্র ধরে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।
শামীমা নূর পাপিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সখ্যতার বিষয়ও এসেছে আলোচনায়। মূলত সুন্দরীদের অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে একের পর এক ক্ষমতার সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে উপরে উঠেছেন তিনি। দলের নেতাকর্মীদের অনেকেই তাকে দূরে রাখতে চাইলেও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ম্যানেজ করে দলীয় অবস্থান শক্ত রেখেছিলেন এই নারী। রাজধানীর তারকা হোটেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাসা-বাড়ি এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছিলো পাপিয়ার প্রভাব। শীর্ষস্থানীয় নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য প্রবাসী এমনকি দাগী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সখ্যতা ছিলো পাপিয়ার। নিজের স্বামী ছাড়াও কয়েক নারী নেত্রী এ বিষয়ে তাকে সহযোগিতা করতেন। সরকারি বিভিন্ন কাজ, চাকরি, বদলির বিষয়ে তদবির করতেন পাপিয়া। এজন্য মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন তিনি। কাজ-কারবার নিয়ে বৈঠক হতো পাপিয়ার অন্দর মহলে। কাজ বাগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণ জানাতেন তারকা হোটেলে। প্রতিটি কাজ বাগিয়ে নিতে ব্যবহার করতেন নারী। শিক্ষিতা, সুন্দরী দেখলেই ঘনিষ্ঠতা বাড়াতেন পাপিয়া। আর্থিক বিষয়ে খোঁজ খবর নিতেন। দুর্বলতা থাকলে সঙ্গে সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। নগদ টাকা দিতেন। চাকরির জন্য ডাকতেন। নারী হয়ে নারীর প্রতি অতিরিক্ত এই সখ্যতাকে অনেকেই রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখতেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন। চাকরির প্রস্তাব দিয়ে, আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে মূলত নারীদের বিপদগামী করতেন তিনি।
যুব মহিলা লীগের এক নেত্রী জানান, পাপিয়া যখনই কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করতে যেতেন সঙ্গে থাকতো পাঁচ-সাত তরুণী। গত বছরের ১২ই অক্টোবর হোটেল ওয়েস্টিনের প্রেসিডেনসিয়াল স্যুইটটি ভাড়া নেন তিনি। প্রভাবশালী, ধনাঢ্যদের সঙ্গে পরিচয় হলেই আমন্ত্রণ জানাতেন নিজের অন্দর মহলে। উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের জন্য ছিল পাপিয়ার হোম সার্ভিস। ধানমন্ডির আবাহনী মাঠ সংলগ্ন এক নারীর বাসায় এই হোম সার্ভিস দিতেন তিনি। ওই বাসাতে আসা যাওয়া করতেন প্রভাবশালী এক নেতা।
ইতিমধ্যে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ওয়েস্টিনের প্রেসিডেন্ট স্যুটে সন্ধ্যার পর গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক হতো। জরুরি বৈঠকগুলো হতো অল্প সময়ের। সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স, বারের লাইসেন্স, নানা বাণিজ্য, চাকরি, বদলির জন্য অনুষ্ঠিত হতো এসব বৈঠক। ঢাকার কাছে একটি রিসোর্টে বারের অনুমতির জন্য পাপিয়ার সহযোগিতা চেয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠ একজন। এ বিষয়ে গ্রেপ্তারের কিছুদিন পূর্বে তারকা হোটেলে পাপিয়ার কক্ষে বৈঠক করেছিলেন কয়েক ব্যবসায়ী। বৈঠক শেষে সেখানেই মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করেছিলেন পাপিয়া। নরসিংদীর বেশ কয়েক সুন্দরী তরুণীদের চাকরির নামে নিজের কাছে এনেছিলেন পাপিয়া। গত বছরের শুরুতেই তাদের আনা হয়। এরমধ্যে এক তরুণী যাত্রাগানে, মঞ্চে নিয়মিত নাচ করতেন। নাচে পারদর্শী হওয়ার কারণে এলাকার একটি অনুষ্ঠানে পাপিয়ার নজরে পড়েন ওই তরুণী। পরবর্তীতে তাকে ঢাকায় আনা হয়। সূত্রমতে, এসব তরুণীদের নিয়মিত টাকা দিতেন। তাদের পরিবারের সদস্যদেরও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। তবে বাইরে কখনও এসব অপকর্ম নিয়ে মুখ খোলা যাবে না বলে হুমকি দিতেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গোপনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ করতেন পাপিয়া। বাইরে কখনও মুখ খুললে এসব ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হবে বলে হুমকি দিতেন। প্রায়ই থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যেতেন পাপিয়া। সেখানেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন তরুণীদের। এসব দেশে অর্থ পাচার করতেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। থাইল্যান্ড ছিলো তার প্রিয়স্থান।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version