বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন ফের খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল দুপুরে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, অবশ্যই তাকে (খালেদা জিয়া) মনে রাখতে হবে যে, তিনি একজন বন্দি। তিনি একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। একজন সাধারণ মানুষ যেভাবে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চিকিৎসা নিতে পারে একজন বন্দি সমস্ত  সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। কারাবিধি ও নিয়ম-নীতি অনুযায়ী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে। দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে তার জন্য সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া, মেডিকেল রিপোর্টে এমন কিছু বলা হয়নি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেগম জিয়ার উন্নত চিকিৎসা করা যাবে না, দিতে পারবেনা কিংবা তারা চিকিৎসা দিতে অক্ষম।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসালয়। ওই হাসপাতাল বেগম জিয়া অনুমতি দিলে উন্নত চিকিৎসা দিতে সক্ষম। এসব বিবেচনায় নিয়ে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হলো। তবে তিনি যদি উন্নত চিকিৎসার সম্মতি দেন, দ্রুত তার সে চিকিৎসা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এমনকি মেডিকেল বোর্ড চাইলে তাদের সদস্যসংখ্যাও বাড়াতে পারবে। আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদূদ আহমেদ ও অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও দুদকের পক্ষে খুরশীদ আলম খান শুনানি করেন।
শুনানিতে অন্যান্যের মধ্যে খালেদা জিয়ার পক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মইনুল ইসলাম চৌধুরী, এজে মোহাম্মদ আলী, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। এসময় উপস্থিত ছিলেন ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। আদেশের পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন হতাশা প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, এ আদেশে আমরা ক্ষুব্ধ। আদালত চাইলে জামিন আবেদনটি বিবেচনায় নিতে পারতেন। জামিন আবেদনে এমন গ্রাউন্ড ছিল। কিন্তু আদালত আমাদের আবেদনটি বিবেচনায় না নিয়ে খারিজ করে দিয়েছেন। আমরা আদালতের কাছে দুদিন সময় প্রার্থনা করেছিলাম। কিন্তু আদালত আমাদেরকে সেই সময়টুকুও দেননি। এমনকি কেন বেগম জিয়া মেডিকেল বোর্ডকে উন্নত চিকিৎসার অনুমতি দিচ্ছেন না, তা জানতে বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়েছিলাম। আদালত আমাদের সেই সুযোগটিও দেননি। এদিকে, বিএনপির অপর এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, হাইকোর্টের জামিন খারিজের আদেশের বিরুদ্ধে তারা আপিল বিভাগে আবেদন করবেন। তার (খালেদা) জামিন খারিজের বিষয়ে যদি দেশে অস্থির অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে এর দায় সরকারকেই নিতে হবে।
এর আগে সকালে জামিন শুনানির শুরুতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভিসি’র পাঠানো মেডিকেল রিপোর্টটি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মো. আলী আকবর বিচারকের কাছে দাখিল করেন। বিচারক সিলগালা রিপোর্টটি খুলে পড়ে শোনান। এতে বলা হয়, খালেদা জিয়া উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিকস, হাইপার টেনশন, অ্যাজমা, ব্যাক পেইন ও প্রতিস্থাপনজনিত হাটুর ব্যাথায় (অস্ট্রিও-আর্থরাইটিস) ভুগছেন। অন্য সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অস্ট্রিও-আর্থরাইটিসের অ্যাডভ্যান্সড ট্রিটমেন্ট শুরুর বিষয়ে তিনি সম্মতি দেননি। এমনকি সেই চিকিৎসার জন্য যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার, সেগুলোও করা যাচ্ছে না। উন্নত চিকিৎসার দেয়ার বিষয়ে তার মতামত জানতে চেয়েছিলো সাত সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। কিন্তু তিনি অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট গ্রহণের বিষয়ে কোনো সম্মতি দেননি। তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, খালেদা জিযার অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট দেশে দেয়া সম্ভন নয়। এখানে এমন কিছু মেডিসিন রয়েছে, যেগুলো পুশ করলে তার মারাত্বক সাইড এফেক্ট রয়েছে। যা নিয়ন্ত্রন করা দেশের হাসপাতালে কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। এজন্য তিনি হয়তো উন্নত চিকিৎসার অনুমতি দিচ্ছেন না। তখন আদালত বলেন, উনিতো চিকিৎসক নন। এরপর খালেদা জিয়ার অন্যতম সিনিয়র আইনজীবী মওদুদ আহমদ আদালতকে বলেন, খালেদা জিয়া কোথায় ট্রিটমেন্ট নিবেন সেটা তার আইনগত অধিকার। তিনি যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নিতে কমফোর্ট না করেন, সেটা তার অধিকার। তিনি যেখানে চাইবেন সেখানেই চিকিৎসা নিতে পারা তার অধিকার। তখন আদালত বলেন, একজন বন্দি সাধারণ মানুষের মতো সুযোগ সুবিধা পাবেনা না। তাকে জেল কোর্ড মেনেই চিকিৎসা নিতে হবে। আমরা এখন আদেশ দিয়ে দেব। এরপর খালেদার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, আমারা তার সঙ্গে দেখা করতে চাই, কেন তিনি উন্নত চিকিৎসার অনুমতি দিচ্ছেন না। নিশ্চয়ই এর পেছনে তার কোনো যুক্তি রয়েছে। আমাদের রোববার পর্যন্ত সময় দিন এবং তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিন। তখন আদালত বলেন, সময় দেয়া যাবে না। আমরা এখনই আদেশ দিব। ফের জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদের আইনজীবীদের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করা দরকার। অন্তত দুপুর পর্যন্ত সময় দিন। পরে আদালত বলেন, আপনারা মেডিকেল রিপোর্ট চেয়েছিলেন, আমরা সেই রিপোর্ট তলব করেছি। রিপোর্ট আদালতে এসেছে। এখন ওই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে আমরা পরবর্তী আদেশ দেব। জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদের একটি সম্পূরক আবেদন রয়েছে। আমরা আবেদনটি আপনার আদালতে দিতে চাই। পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, খালেদা জিয়ার এই রোগগুলো দীর্ঘদিন ধরেই আছে। যখন কোনো বন্দি কারাগারে থাকেন তখন সরকারেরও তার বিষয়ে উদ্বেগ থাকে। এ পর্যায়ে কোনো সম্পূরক আবেদন দেয়ার সুযোগ নেই। পরে আদালত দুপুরে আদেশ দেবেন বলে জানান।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল রিপোর্ট সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে গতকাল উচ্চ আদালতে দাখিলের নির্দেশ ছিল। সে অনুযায়ী খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি হাইকোর্টের কার্যতালিকার ৫ নম্বরে ছিল। এই উপলক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টে নেয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা। হাইকোর্টের প্রতিটি গেটে বিচার প্রার্থীদের তল্লাশি, আইনজীবী এবং সাংবাদিকদের আইডি কার্ড চেক করে ভিতরে প্রবেশ করতে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এনেক্স ভবনে প্রবেশ করতেও অন্যদিনের তুলনায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। দ্বিতীয় তলায় ১৯ নম্বর কোর্টের সামনেও দেখা যায় বেশ কিছু পুলিশের উপস্থিতি। এর আগে বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিপোর্টটি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্মতি দিয়েছেন কিনা, সম্মতি দিলে চিকিৎসা শুরু হয়েছে কিনা এবং শুরু হলে কী অবস্থা তা জানাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার আদেশের জন্য তা কার্যতালিকায় আসে এবং আদালত মেডিকেল রিপোর্ট পর্যালোচনা করে খালেদার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন।
দুর্নীতির দুই মামলায় মোট ১৭ বছরের দণ্ড মাথায় নিয়ে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গত বছরের এপ্রিল থেকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দল ও পরিবারের সদস্যরা তাকে অন্য হাসপাতালে নিতে চাইলেও তাতে অনুমতি মেলেনি। এর আগে ৩১শে জুলাই হাইকোট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় জামিনের জন্য খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন। খালেদার আইনজীবীরা এরপর আপিল বিভাগে যান। আপিল বিভাগের নির্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া গত বছরের ১১ই ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার সর্বশেষ স্বাস্থ্যগত অবস্থা ও চিকিৎসা প্রতিবেদন আদালতে পাঠান। পরে ১২ই ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল তা সর্বোচ্চ আদালতের কাছে হস্তান্তর করেন। ওই বোর্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়, খালেদা জিয়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কফজনিত শ্বাসকষ্ট (কফ ভেরিয়েন্ট অ্যাজমা), প্রতিস্থাপনজনিত হাঁটুর ব্যথায় (অস্টিও-আর্থরাইটিস) ভুগছেন। গেঁটে বাতসহ বেশ কিছু সমস্যায় উন্নত চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য খালেদা জিয়া সম্মতি দিচ্ছেন না বলে তার যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে না। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর শুনানি শেষে গত ১২ই ডিসেম্বর আপিল বিভাগ কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনটি খারিজ করে দেন। আপিল বিভাগের ওই রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের সম্মতি থাকলে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে দ্রুত অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্ট দেয়ার পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। গত ১৯ জানুয়ারি সেই রায় প্রকাশিত হওয়ার পর হাইকোর্টে নতুন করে ফের জামিন আবেদন করার উদ্যোগ নেন খালেদার আইনজীবীরা।
সারাদেশে বিএনপির বিক্ষোভ কাল
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজের প্রতিবাদে আগামীকাল সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূিচ পালন করবে বিএনপি। একইদিনে বেলা দুইটায় নয়াপল্টন্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে দলটি। গতকাল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, আজ (গতকাল) বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের আদেশের শুনানীর দিন ধার্য ছিল। কিন্তু জামিন আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়েছে। এই খারিজ আদেশের মধ্য দিয়ে সরকারের হিংসাশ্রয়ী নীতিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। সরকার মুক্তিপণ আদায়ের মতোই দেশনেত্রীকে অন্যায়-অন্যায্য ও সকল আইনী অধিকার লঙ্ঘন করে কারারুদ্ধ করে রেখেছে। আর এই কারারুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে সরকার তাদের অবৈধ ক্ষমতা ধরে রাখার মুক্তিপণ আদায়ের মতোই আচরণ করছে।
রিজভী আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রের মালিকানা এখন আর জনগণের হাতে নেই। তা এখন অবৈধ শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারী যন্ত্রের হাতে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিপীড়ণ যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। সুতরাং মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। জনগণ বিশ্বাস করে প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিকে নিশ্চিহ্ন করতে কারাগারে অন্তরীণ করেছে। তাই বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে সরকার প্রধান হিংসা চরিতার্থ করতে টার্গেট করেছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version