ভ্রাম্যমাণ আদালতে কোনো শিশুকে সাজা দেয়া অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। একইসাথে টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা ১২১ শিশুকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে দেয়া দণ্ড অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।

স্ব:প্রণোদিত হয়ে জারি করা এক রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে বুধবার এ রায় দিয়েছেন বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও  ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার। শিশুদের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম ও আইনজীবী ইশরাত হাসান।

রায়ের পর ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম সাংবাদিকদের জানান, আদালত স্পষ্টভাবে বলেছেন ১২১ শিশুর সাজা প্রদান সম্পূর্ণভাবে অবৈধ এবং কোনো শিশুকেই মোবাইল কোর্ট কোনো ধরনের সাজা দিতে পারবে না। টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা ১২১ শিশু অন্য কোনো অপরাধে জড়িত না থাকলে তাদেরকে তাৎক্ষণিক মুক্তি দিতে বলা হয়েছে।

তিনি জানান, আইন অনুযায়ী একমাত্র শিশু আদালতই শিশুদের দণ্ড দিতে পারবে। অন্য কোনো আদালত দণ্ড দিলে তা অবৈধ হবে। মোবাইল কোর্ট যদি শিশুদের দণ্ড প্রদান করে তবে তা সংবিধানের সাংবিধানিক ও মৌলিক মানবাধিকার সংক্রান্ত ৩০ ও ৩৫ ধারার পরিপন্থী হবে।

আদালতের বরাত দিয়ে ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম আরও জানান, এই মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে দেশে দুই ধরনের বিচার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। স্বাভাবিক বিচার ব্যবস্থা এবং মোবাইল কোর্ট বিচার ব্যবস্থা। আর মোবাইল কোর্ট বিচার ব্যবস্থা স্বাভাবিক বিচার ব্যবস্থার সাথে একটি সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করছে। যা শুধু অসাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থীই নয়, গণতান্ত্রিক ন্যায়নীতি ও মানবাধিকারের পরিপন্থী।

এর আগে গত বছরের ৩১ অক্টোবর ‘আইনে মানা, তবু ১২১ শিশুর দণ্ড’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একই দিন প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন হাইকোর্টের নজরে আনেন ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম। পরে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দণ্ডিত দুটি শিশু সংশোধন কেন্দ্রে থাকা ১২ বছরের নিচের শিশুদের অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দেয় আদালত।

এছাড়া বাকিদের ছয় মাসের জামিন দেয়া হয়। তারা সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতে জামিননামা দেয়ার পর মুক্তি পাবেন। একইসাথে ভ্রাম্যমাণ আদালতে শিশুদের দণ্ড প্রদান কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। এরপর বিভিন্ন সময়ে ওই শিশুদের মুক্তি দেয়া হয়। বুধবার রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় দেয় হাইকোর্ট।

টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডিত ১২১ শিশু সেখানে রয়েছে। এদের মধ্যে ১৭ বছর বয়সী রয়েছে ২৮ জন। এছাড়া ২৬ জনের বয়স ১৬, ২০ জনের বয়স ১৫, ১৬ জনের বয়স ১৪, ১১ জনের বয়স ১২, ৭ জনের বয়স ১৩ এবং ১২ জনের বয়স ৮ থেকে ১১ বছর। বাকি একজনের বয়স উল্লেখ নেই।

দণ্ডিতদের মধ্যে ৭৫ জনকে দণ্ডবিধির ৩৫৬ ধারা অনুযায়ী চুরির দায়ে ছয় মাস এবং ৩৪ জনকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী এক বছর করে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ বছর বয়সী এক শিশুকে সরকারি কর্মচারীকে ক্ষতিসাধনের হুমকির অভিযোগে দণ্ডবিধির ১৮৯ ধারা অনুযায়ী ছয় মাসের সাজা দেয়া হয়েছে।

এছাড়া যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রেও ভ্রাম্যমাণ আদালতে দণ্ডিত এক শিশু রয়েছে। কেশবপুরের ওই শিশু বাল্যবিয়ের কারণে এক মাসের সাজা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ।

২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ‘বিদ্যমান অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হবে।’

১৬ ধারা অনুযায়ী, ‘আইনের সাথে সংঘাতে আসা শিশুর সংঘটিত যেকোনো অপরাধের বিচার করার জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে এক বা একাধিক শিশু আদালত থাকবে। কোনো অপরাধ সংঘটনে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু একত্রে জড়িত থাকলেও শিশুর বিচার শুধু শিশু আদালতই করবে। শিশু আদালতের সাজসজ্জা ও ধরন ভিন্ন হতে হবে। অপরাধ অজামিনযোগ্য হোক বা না হোক, আদালত শিশুকে জামিনে মুক্তি দিতে পারবে। এমনকী আদালতে কোনো শিশুর প্রথম হাজির হওয়ার ২১ দিনের মধ্যে প্রবেশন কর্মকর্তা একটি সামাজিক অনুসন্ধান দাখিল করবেন। প্রবেশন কর্মকর্তা বা বৈধ অভিভাবকসহ আইনজীবীর উপস্থিতি আদালতে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।’ সূত্র : ইউএনবি

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version