২০০৯ সালের জানুয়ারির সেই বিষণ্ন বিকেল। কিংবা ৯ বছর পর এই জানুয়ারির হতাশার রাত। ২০১২ ও ২০১৬ সালে দুটি এশিয়া কাপের ফাইনালে হারের ক্ষত। ফাইনালে একটির পর একটি হারের হতাশার স্মৃতিতে যোগ হলো নতুন অধ্যায়। আবার কাছে গিয়েও না পাওয়ার যন্ত্রণায় পুড়ল বাংলাদেশ। শেষ বলে ছক্কায় ভারতকে ফাইনাল জেতালেন দিনেশ কার্তিক।

মাত্র ৮ বল খেলেছেন কার্তিক। তবু তার ইনিংসটি যেন মহাকাব্যিক। ২৯ রানের অপরাজিত ইনিংসে লিখে দিলেন টুর্নামেন্টের ভাগ্য। বাংলাদেশ দলের মুঠো থেকে যেন ট্রফি ছিনিয়ে নিল সেই ইনিংস। রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে ৪ উইকেটের জয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজের চ্যাম্পিয়ন ভারত।

প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে রোববার ফাইনালে বাংলাদেশের ১৬৬ রান তাড়ায় শেষ বলে ভারতের প্রয়োজন ছিল ৫ রান। সৌম্য সরকারের বলটি এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে সীমানার ওপারে আছড়ে ফেলেন কার্তিক।

এমন ম্যাচে শেষ ওভারে সৌম্যর হাতে বলই বলে দিচ্ছে ম্যাচের শেষ দিকে বাংলাদেশের টানাপোড়েনের চিত্র। অফ স্পিনার মিরাজ প্রথম ওভারে ১৭ রান দেওয়ার পর একের পর এক ডানহাতি ব্যাটসম্যানের সামনে তাকে আর বোলিংয়ে আনার সাহস পাননি অধিনায়ক। সৌম্যর হাতে ভাগ্য সঁপে দেওয়া ছিল সেই ঘাটতি পূরণেই।

তবে ভারত ট্রফির কাছে এগিয়েছে সৌম্যর করা শেষ ওভারের আগেই। পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকা ম্যাচে বাংলাদেশকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিল মুস্তাফিজুর রহমানের অসাধারণ এক ওভার।

৩ ওভারে যখন ভারতের প্রয়োজন ৩৫ রান, ১৮তম ওভারে বোলিংয়ে এসে মুস্তাফিজ রান দিলেন না একটিও। লেগ বাই থেকে হলো স্রেফ একটি রান। শেষ বলে ফিরিয়ে দিলেন বিপজ্জনক মনিশ পান্ডেকেও।

২ ওভারে ৩৪ রানের সমীকরণে ম্যাচ গেল বাংলাদেশের দিকে। বল হাতে তখন রুবেল, দলের ভরসা তাতে বেড়ে যাওয়ার কথা আরও। ৩ ওভারে ১৩ রান দিয়ে ম্যাচে দলের সেরা বোলার তখন তিনি।

কিন্তু রুবেল ফিরে গেলেন যেন ৯ বছর আগে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে। শেষ দিকে তার এক ওভারে ২০ রান নিয়ে ম্যাচের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। এবার সেই রুবেলকে বেছে নিলেন কার্তিক। প্রথম তিন বলেই ছক্কা, চার, ছক্কা। শেষ বলে আবার চার। ওভার থেকে ২২!

অনিয়মিত হয়েও সৌম্য শেষ ওভারে চেষ্টা করেছেন সাধ্যমত। চতুর্থ বলে বাউন্ডারি হজমের পর পঞ্চম বলে নেন উইকেট। কিন্তু শেষ বলটায় শেষের নায়ক হয়ে রইলেন কার্তিকই।

১৬৭ রান তাড়ায় ভারতকে এগিয়ে নিয়েছিল অধিনায়ক রোহিত শর্মার ৫৬ রানের ইনিংস। মাঝে মনিশ পান্ডে, লোকেশ রাহুলরা চেষ্টা করেছেন ঝড় তোলার। কিন্তু প্রতিবারই ম্যাচে ফিরেছে বাংলাদেশ। শেষটায় পেরে উঠল না কেবল কার্তিকের কাছেই।
ম্যাচের শুরুটায় বাংলাদেশের ইনিংস আলাদা করা যায় দুটি ধাপে। পাওয়ার প্লের প্রথম ৩ ওভারে সম্ভাবনার আলো, পরের তিন ওভারে হতাশার আঁধার।

তামিম ইকবাল ও লিটন দাস প্রথম ৩ ওভারে তোলেন ২৬ রান। কিন্তু পরের ৩ ওভারে ১৪ রান আসে ৩টি উইকেট হারিয়ে।

ওয়াশিংটন সুন্দরের জবাব এদিনও পাননি লিটন। স্লগ সুইপ করতে গিয়ে উইকেট দিয়ে ফেরেন ১১ রানে। পরের ওভারে আক্রমণে যুজবেন্দ্র চেহেল, প্রথম ওভারেই জোড়া ধাক্কা।

লেগ স্পিনারকে শুরুতেই চাপে ফেলতে গিয়ে তামিম উল্টো চাপে ফেলেন দলকে। আকাশছোঁয়া বলটি সীমানায় দারুণভাবে হাতে জমান শার্দুল ঠাকুর। ওভারের শেষ বলে বাজে শটে শেষ সৌম্য সরকার।

টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে নতুন করে চেনানোর সিরিজের শেষটায় নিপুন তুলির আঁচড় দিতে পারেননি মুশফিক। বিভ্রান্ত হয়েছেন চেহেলের চাতুর্যে। মুশফিককে বেরিয়ে আসতে দেখে অনেকটা বাইরে পিচ করিয়ে গুগলি করেন চেহেল। ১২ বলে ৯ রানে ফেরেন মুশফিক।

আরেক পাশে সাব্বির তখন অনেকটাই থিতু। শুরুতে অনেক বেশি শট খেলতে গিয়ে টাইমিং পাননি ঠিকমত। পরে খুঁজে পান ছন্দ। আগের ম্যাচের নায়ক মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে দেখা গেল একই স্ফুলিঙ্গ। বাংলাদেশের ইনিংসটি একটু গতি পায় এই জুটিতে।

আশা জাগানিয়া জুটির সমাপ্তি দৃষ্টিকটু রান আউটে। এক প্রান্তে পরস্পরকে দেখে হতভম্ব দুজন। ১৬ বলে ২১ করে ত্যাগ স্বীকার করে ফেরেন মাহমুদউল্লাহ।

এরপর আরেকটি ছোট জুটি। এবারও সম্ভাবনার অপমৃত্যু রান আউটের হতাশায়। সাকিব আল হাসানের বিদায় ৭ রানে।

সাব্বির অবশ্য নিজের কাজটা করছিলেন দারুণভাবে। সাকিব আউট হওয়ার আগে দুটি ছক্কা মারেন বিজয় শঙ্করকে। ছক্কায় ওড়ান দারুণ কিপটে সুন্দরকেও। ৩৭ বলে স্পর্শ করেন পঞ্চাশ।

টি-টোয়েন্টিতে এটি তার চতুর্থ ফিফটি। প্রথম ১৬ ইনিংসে করেছিলেন তিন ফিফটি। মাঝে ২১ ইনিংস বিরতির পর আবার পেলেন পঞ্চাশের দেখা।

প্রয়োজন ছিল ফিফটির চেয়ে আরও বেশি কিছু। সাব্বিরও ছুটছিলেন সেই পথেই। তবে শেষ করে আসতে পারেননি। শেষের আগের ওভারে আউট জয়দেব উনাদকাটের স্লোয়ারে। ৭ চার ও ৪ ছক্কায় ৭৭।
বিবর্ণ ওই ওভারের পর শেষের আলোর ছটা মিরাজের ব্যাটে। শার্দুল ঠাকুরের করা শেষ ওভারে দুই চারের মাঝে মারেন বিশাল এক ছক্কা। ওই ওভারের ১৮ রান বাংলাদেশকে দেয় লড়ার টনিক।

লড়াই হয়েছে ঠিকই। কিন্তু লড়াইটুকু মনে রাখে কজন! শেষটা যে আবারও তেতো।

শুক্রবার এই মাঠেই স্বাগতিক দর্শকদের স্তব্ধ করে ঘরের দলকে বিদায় করে দিয়েছিল বাংলাদেশ। এদিন ম্যাচ জুড়েই প্রায় ২৫ হাজার দর্শক গগন বিদারী চিৎকারে সমর্থন দিয়ে গেল ভারতকে। মনেই হয়নি ফাইনালে নেই স্বাগতিক দল। ভারতীয় দলও সেটির কৃতজ্ঞতা জানাল জয়ের পর মাঠ প্রদক্ষিণ করে।

বাংলাদেশের ড্রেসিং রুম তখন ডুবে হতাশার আঁধারে। সবুজ পোশাকের মানুষগুলো যেন নীল হয়ে আছে পঞ্চম ফাইনাল হারের যন্ত্রণায়!

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৬৬/৮ (তামিম ১৫, লিটন ১১, সাব্বির ৭৭, সৌম্য ১, মুশফিক ৯, মাহমুদউল্লাহ ২১, সাকিব ৭, মিরাজ ১৯*, রুবেল ০, মুস্তাফিজ ০*; উনাদকাট ২/৩৩, সুন্দর ১/২০, চেহেল ৩/১৮, শার্দুল ০/৪৫, শঙ্কর ০/৪৮)

ভারত: ২০ ওভারে ১৬৮/৬ (রোহিত ৫৬, ধাওয়ান ১০, রায়না ০, রাহুল ২৪, মনিশ ২৮, শঙ্কর ১৭, কার্তিক ২৯*, সুন্দর ০*; সাকিব ১/২৮, মিরাজ ০/৩১, রুবেল ২/৩৫, নাজমুল অপু ১/৩২, মুস্তাফিজ ১/২১, সৌম্য ১/৩৩)

ফল: ভারত ৪ উইকেটে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: দিনেশ কার্তিক

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version