বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘ হওয়ায় নতুন কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। জামিন হওয়ার আগ পর্যন্ত কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে পরিকল্পনা করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। চেয়ারপারসনের জামিনের বিষয়টি আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি আরও জোরদারে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত ও চেয়ারপারসনের কারামুক্তি- এ দুই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে প্রভাবশালী দেশের সমর্থন আদায়েও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। আর বর্তমান পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে দলের ঐক্য ধরে রাখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে হাইকমান্ড।

দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়ে বলেন, চেয়ারপারসনের কারামুক্তি বিলম্ব হতে পারে- এটা আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম। সেই আশঙ্কা থেকে আমরা সিনিয়র নেতারা চেয়ারপারসনের সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করি। সেখানে এ বিষয়টি আলোচনাও হয়। চেয়ারপারসন নিজেই তার কারামুক্তি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। জামিন বিলম্ব হলে, পরবর্তী করণীয় নিয়ে তিনি আমাদের কিছু দিকনির্দেশনাও দেন। তারা আরও বলেন, কারাগারে বৈঠককালে বিএনপিকে নিয়ে সরকারের সম্ভাব্য বিভিন্ন কৌশলের কথা চেয়ারপারসন আমাদের অবহিত করেন। তিনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, বিএনপিকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দলের ভেতর বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে সরকার। পাশাপাশি আমাকেসহ সিনিয়র নেতাদের কারাগারে রেখে নির্বাচন থেকে বিএনপিকে দূরে রাখতে চাইবে। তাই সরকারের এ কৌশল মোকাবেলায় সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। জোর দেন ঐক্যের ওপর।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার চেয়ারপারসনের জামিন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় নতুন কৌশল চূড়ান্ত করতে সিনিয়র নেতারা কয়েক দফা বৈঠক করেন। সোমবার রাতে চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন তারা। সেখানে সরকারের কৌশল মোকাবেলায় পাল্টা কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। চেয়ারপারসনের নির্দেশনা ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরামর্শে বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন কৌশল চূড়ান্ত করছেন তারা। সরকার যতই কঠিন হোক, বিএনপি এ মুহূর্তে ততটাই ধৈর্যের পরিচয় দেবে- এমন বার্তা কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলের সর্ব স্তরের নেতাদের পাঠানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে কোনো মূল্যে দলের ঐক্য ধরে রাখার ওপর।

আরও জানা গেছে, খালেদা জিয়ার কারামুক্তির বিষয়টি আইনের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবছে দলটি। বিএনপির নেতারা মনে করেন, তাদের প্রত্যাশা ছিল- চেয়ারপারসনকে যে মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে, উচ্চ আদালত তাকে জামিন দেবেন। কিন্তু জামিন নাকচের বিষয়টিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলেই মনে করছেন তারা। এ বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছেও তুলে ধরতে তৃণমূলে বার্তা দেয়া হয়েছে। এতে নির্বাচনে বিএনপির ভোটের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে দলটির হাইকমান্ড।

উল্লিখিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে যৌথসভা করে সবাইকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। এ লক্ষ্যে ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের সক্রিয় করতে আজ ঢাকায় এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া শিগগির জোট শরিকদের নিয়ে বৈঠক করা হবে। এ বৈঠকের পর খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দলের পাশাপাশি জোটগতভাবে নতুন কর্মসূচি দেয়া হতে পারে। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার জামিন ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে আন্তর্জাতিকভাবেও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে চেয়ারপারসনকে জামিন দেয়া হচ্ছে না এবং বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চাইছে সরকার- এমন বার্তা দিতে শিগগির ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। এ ছাড়া প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও চীনের সমর্থন আদায়ে চলছে নানা তৎপরতা। লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই এ বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছেন। দলের সিনিয়র কয়েক নেতা তার পরামর্শে কাজ করে যাচ্ছেন। সূত্র জানায়, এমন চিন্তাভাবনা থেকেই খালেদা জিয়ার মামলায় যুক্তরাজ্যের আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিষয়টি যাতে আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা যায়, সে জন্যই তাকে নিয়োগ দেয়া হয়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে সরকার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। সরকার আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করে চেয়ারপারসনের জামিন আটকে দিয়েছে, এটা এখন সবাই বিশ্বাস করে। জামিন পাওয়া না-পাওয়ার বিষয়টি এখন সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপিকে বাদ দিয়ে সরকার আবারও একটা একতরফা নির্বাচন করার চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু এবার সেটা পারবে না। দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে আজ ঐক্যবদ্ধ।

ফখরুল বলেন, সরকার বারবার বিএনপিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। কিন্তু আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমেই চেয়ারপারসনকে মুক্ত করব। আইনের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি মোকাবেলায় যা যা করা প্রয়োজন, তাই করা হবে বলে জানান তিনি।

সরকার বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার চিন্তাভাবনা করছে বলেই মনে করছেন দলটির নেতারা। তাদের মতে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও যাতে তাদের পূর্ণ প্রস্তুতি না থাকে, সে জন্য নেতাকর্মীদের মামলা-হামলায় ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। সরকারের এমন মনোভাব বুঝতে পেরে বিএনপিও তাদের পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছে। মামলা-হামলার মধ্যেও নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরে যায়নি তারা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে গোপনে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। প্রার্থী বাছাই, ইশতেহার তৈরিসহ নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টরা কাজ করে যাচ্ছেন। খালেদা জিয়া কারাগারে থাকলেও এ প্রস্তুতিতে কোনো ভাটা পড়েনি। তার কারাবাস দীর্ঘ হওয়ায় নির্বাচনের প্রস্তুতি আরও জোরদার করার চিন্তাভাবনা রয়েছে দলটির। ভোটারদের সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগ বাড়াতে নেতাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র সাধারণ ভোটারদের মাঝে তুলে ধরতে বলা হয়েছে।

দলটির নেতারা মনে করেন, সরকার নানা ছলচাতুরী করে চেয়ারপারসনের জামিন বিলম্ব করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে কারাগারে রাখতে পারবে না। নির্বাচনের আগে তিনি জামিনে বের হবেন। জামিন পাওয়ার পর নির্বাচনী কর্মকাণ্ড নিয়ে যাতে নতুন করে প্রস্তুতি নিতে না হয়, সে জন্য আগেভাগেই এসব কাজ সেরে ফেলতে চান তারা।

বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়েও ইতিবাচক দলটি। চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতেই এসব নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ভাবছে দলটি। খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় সাধারণ ভোটারদের সমর্থন বেশি পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা।

বিএনপির ভাইচ চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু বলেন, সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আদালতকে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে চেয়ারপারসনকে কারাবন্দি করেছে। আইনের মাধ্যমে তিনি যাতে জামিন না পান, সেই পথও রুদ্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু মিথ্যা মামলায় আদালতকে চাপে রেখে সরকার বেশিদিন খালেদা জিয়াকে বন্দি রাখতে পারবে না।

তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত চেয়ারপারসন মুক্ত না হবেন ততদিন আন্দোলন চলবে। রাজনৈতিকভাবে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হবে। একই সঙ্গে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, বিএনপি এখন কঠিন সময় পার করছে এতে সন্দেহ নেই। সরকার নানাভাবে বিএনপিকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে আবারও একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু এবার কোনোকিছু বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া হবে না। যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি। যতই চেষ্টা করুক বিএনপিকে বাদ দিয়ে এবার নির্বাচন এ দেশে হতে দেয়া হবে না।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version