সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পশ্চিমা গণমাধ্যমের রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকারেরা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) সভাপতি পদের মেয়াদের সময়সীমা অবলোপন করা এবং এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকার পথ উন্মুক্ত হওয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা করছেন। তাঁরা চীনের এই খবরকে হতাশার সঙ্গে নিয়েছেন এবং দেশটির এই রাজনৈতিক মডেলের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। এতে অবশ্য চমকানোর কিছু নেই। চমকে দেওয়ার মতো বিষয় যেটি, সেটি হলো তাঁরা দাবি করছেন যে চীন পশ্চিমাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য ভবিষ্যতে কিছু শক্ত প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করতে যাচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, চীন একটা সময়ে অনিবার্যভাবেই পশ্চিমা ঘরানার উদার গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করবে। সিপিসির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অন্যদের মতো আমাকেও কিছুটা অবাক করেছে বটে, কিন্তু আধুনিক জমানার চীনের নীতিকে সরলভাবে বিশ্লেষণ করা যুক্তিযুক্ত হবে—এটি আমি কখনোই মনে করিনি।

আমি এই যুক্তিতে যাচ্ছি না যে পশ্চিমা ঘরানার গণতন্ত্রের চেয়ে অনির্বাচিত প্রতাপশালী নেতৃত্ব বড় বা ভালো কিছু। সি চিন পিং পরবর্তী ২০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় লৌহমুষ্টি দিয়ে চীন শাসন করার পাঁয়তারা করছেন বলে যদি আমি বিশ্বাস করতাম, তাহলে হয়তো এ নিয়ে বিতর্ক করতাম। কিন্তু আমাকে আরও খোলা মনে বিশ্লেষণ করার সুযোগ দিন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউয়েন উয়েন অং তাঁর হাউ চায়না এসকেপড দ্য পোভার্টি ট্র্যাপ বইয়ে আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পশ্চিমা কায়দার উন্নয়ন মডেল অনুসরণ না করেও চীন তার কোটি কোটি নাগরিককে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে পেরেছে। সম্প্রতি বেইজিংভিত্তিক একজন তরুণ উদ্যোক্তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। তিনি আমাকে জানালেন, চীনের কমপক্ষে ২০ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫ কোটি লোক এখন বছরে ৪০ হাজার ডলার উপার্জন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পরে পৃথিবীর আর কোনো দেশের এতসংখ্যক লোক এই পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারছে না। পশ্চিমারা স্বীকার করুক আর না করুক, এটি একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।

এর চেয়েও বড় উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই অর্জন এসেছে অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে এবং চীনের সাধারণ মানুষ সেই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে আগের চেয়েও তৃপ্ত। অবশ্য সেখানে খুব কম মাত্রার ক্ষোভ-বিক্ষোভ যে একেবারে নেই তা নয়। স্বচ্ছন্দে থাকা ২০ শতাংশ মানুষের মধ্যেও ছিটেফোঁটা ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখা যায়।

এবার ভেবে দেখুন, চীন যদি পরবর্তী ১৫ বছর সাড়ে ৫ থেকে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে, তাহলে বছরে ৪০ হাজার ডলার কামাই করা লোকের সংখ্যা বর্তমানের দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সেই অবস্থায় সম্ভবত তাঁরা সি চিন পিংকে তাঁদের দেহে তেলের মতো লেপ্টে রাখার মতো নেতা মনে করবেন না।

এ বিষয়টি আমাকে দ্বিতীয় ভাবনায় নিয়ে এসেছে। দ্বিতীয় ভাবনাটি হলো চীনের আবাসন প্রকল্প, যেটি হুকৌ (হাউসহোল্ড রেজিস্ট্রেশন) সিস্টেম নামে পরিচিত, সেটি বাড়তে থাকবে। এই কার্যক্রমের কারণে গ্রামের মানুষ নাগরিক সুবিধার আশায় শহরে আসতে আগ্রহী হয়। সরকার মনে করছে, বড় বড় শহরের বাইরে ছোট ছোট শহর গড়ে তুলতে পারলে বেইজিং ও সাংহাইয়ের মতো বড় শহরের ওপর চাপ কমবে। অন্যদিকে, শিল্প উৎপাদনও সম্প্রসারিত হবে।

চীনে এখন দুটি বলয়—একটি শহরকেন্দ্রিক, অন্যটি গ্রামকেন্দ্রিক। শহরের মানুষ যেসব শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পায়, গ্রামের মানুষ তা পায় না। আগামী ১৫ বছরে গ্রামের এই বিশাল জনপদ এই বৈষম্য মেনে নেবে বলে মনে হয় না। ফলে সরকারকে তাদের নাগরিক সুবিধার আওতায় আনতে হবে। সমাজের বৃহৎ অংশ সচ্ছল ও পশ্চিমা জীবনযাপনের সুবিধা পেয়ে গেলে তাদের রাজনৈতিক ভাবনায়ও পরিবর্তন আসবে। সে বিষয়টি সিপিসিও মাথায় রেখেছে বলে আমার ধারণা।

২০১৩ সালের মার্চে সি চিন পিং যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি যেসব পরিবর্তন আনছিলেন, দলের শীর্ষস্থানে থাকা কিছু নেতা সেসবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। অবশ্য সেসব বিরোধিতা চিন পিং ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন। তবে তাঁর শাসনের ১০ বছরের মাথায় তাঁর সেই নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পেতে পারে। আমার জোরালো বিশ্বাস, ভবিষ্যতে চীনে যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে, তাতে সিপিসির নেতারা চাইবেন না চিন পিং স্থায়ীভাবে প্রেসিডেন্ট থাকুন। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, চীনের রাজনৈতিক কাঠামো বা নেতৃত্বে কী পরিবর্তন আসবে, তা বুঝতে হলে দেশটির অর্থনৈতিক গতিধারার দিকে নজর রাখতে হবে। অর্থনীতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাপনের ধারা পরিবর্তিত হচ্ছে। সেই সামাজিক পরিবর্তন চীনের বিদ্যমান নীতিকেও শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলবে বলে আমার বিশ্বাস। (জিম ও’নেইল : প্রথম আলো)

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version