বাসাবাড়ি বাদ রেখে অন্যসব খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা দিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। মঙ্গলবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) তিতাস গ্যাসসহ অন্য কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা দেয়। কোম্পানিগুলো একই হারে দাম বাড়ানোর অভিন্ন প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এতে গড়ে ৭০ থেকে ৪০০ শতাংশের বেশি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাবের ওপর গণশুনানির জন্য বিইআরসি দু’য়েক দিনের মধ্যে তারিখ নির্ধারণ করবে। নিয়ম অনুযায়ী গণশুনানি শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে যে কোনো সময় দাম বাড়ানো কিংবা সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত কার্যকরের ঘোষণা দেয়া হয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী মাসের ২৬ তারিখের আগে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানা, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সিএনজি, শিল্প-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে আবাসিক বা গৃহস্থালির গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। বর্তমানে মোট উৎপাদিত গ্যাসের প্রায় ১৫ শতাংশ বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন তারা। বিইআরসিই এখন সিদ্ধান্ত নেবে দাম বাড়ানো হবে কি হবে না।

সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য ২০০ শতাংশ আর সার কারখানার জন্য ৪০০ শতাংশের বেশি হারে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া অন্য শিল্প কারখানা, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সিএনজিসহ অন্য খাতগুলোতে ৪০ থেকে ১০০ শতাংশ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য খরচ হচ্ছে ৩.১৬ টাকা। এই খাতে নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে প্রতি ইউনিট ১০ টাকা। এই খাতে উৎপাদিত গ্যাসের ৪১ শতাংশের বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া সার কারখানায় বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য দাম দিতে হয় ২.৭১ টাকা। এক্ষেত্রে নতুন প্রস্তাব করা হয়েছে ১২.৮০ টাকা। উৎপাদিত মোট গ্যাসের প্রায় ১০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় সারখানায়। আর শিল্প-কলকারখানায় বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য খরচ হচ্ছে গড়ে ৭.৭৬ টাকা। এ খাতে প্রস্তাব অনুযায়ী, ১০০ শতাংশের মতো বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এই হিসাবে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ১৫ টাকা। অপর দিকে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস সিএনজিতে আগে দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৪০ টাকা। নতুন করে এই খাতে দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৮ টাকা। এছাড়া ক্যাপটিভ পাওয়ারে আগে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল ৯.৬২ টাকা। নতুন প্রস্তাবে দাম বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ১৬ টাকা। চা বাগানের আগে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ছিল ৭.৪২ টাকা। নতুন প্রস্তাবে দাম বাড়িয়ে করা হযেছে ১২.৮০ টাকা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর মশিউর রহমান বলেন, তারা গ্যাসে মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে জমা দিয়েছেন। তার মতে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এই প্রস্তাব তৈরি করেছেন তারা। এখন বিইআরসিই সিদ্ধান্ত নেবে কত টাকা দাম বাড়ানো হবে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বাসাবাড়ির জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোনো প্রস্তাব দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) জন্য দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব কম করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য মাত্র ৮ টাকা দাম বাড়িয়ে ৪৮ টাকা করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। তার মতে সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ পাওয়ার ও সার উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য। বর্তমানে মোট উৎপাদিত গ্যাসের ৪১ শতাংশই বিদ্যুৎ খাতে খরচ হয়। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানা গেছে, আগামী মাসের ২৬ তারিখ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। এর আগেই সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবে। চলতি বছর ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে ১৪ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হবে। এই টাকা সমন্বয় করতে গ্যাসের দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে যুগান্তরের কাছে মন্তব্য করেছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। গত সপ্তাহে তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ সব বিতরণ কোম্পানিকে এলএনজির দাম সমন্বয় করে প্রস্তাব তৈরি করে বিইআরসির কাছে জমা দিতে বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী বিতরণ কোম্পানিগুলো মঙ্গলবার প্রস্তাব জমা দেয়। গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি সরকার গ্যাসের গড় মূল্য ২২.৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে। বিইআরসি দুই দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিলেও উচ্চ আদালতের রায়ে দ্বিতীয় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। সরকার গত কয়েক বছরে সাড়ে ৩শ’র বেশি শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগের অনুমোদন দিলেও তা অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি। পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকায় সরকার এসব শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ দিতে পারছে না। এ কারণে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আগামী এপ্রিলে প্রথম দফায় ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। এই গ্যাস এলএনজি আকারে এলেও তা গ্যাসে রূপান্তর করে জাতীয় গ্রিডে মিশ্রণ আকারে যোগ করা হবে। দ্বিতীয় দফায় অক্টোবর মাসে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি বর্তমান গ্যাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে।

এজন্য সরকারকে অতিরিক্ত ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা বেশি অর্থ গুনতে হবে। এর মধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকা জোগান হবে এনার্জি সিকিউরিটি ফান্ড থেকে। বাকি টাকার জোগান দিতে সরকার আন্তর্জাতিক ইসলামী ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে উচ্চ মূল্যের ঋণ নেয়ার পাশাপাশি গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার এলএনজি বিক্রি হচ্ছে ১৩.৫২ টাকায়। অপরদিকে স্থানীয়ভাবে দেশে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম রাখা হচ্ছে গড়ে ৭.৩৫ টাকা। এতে ঘাটতি দাঁড়ায় ৬.১৭ টাকা। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ২৬৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেক গ্যাস চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে। অথচ এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম পাচ্ছে মাত্র ২.৭০ টাকা থেকে সাড়ে ৩ টাকা। এখানেও সরকার সাড়ে তিন টাকার বেশি ভর্তুকি দিচ্ছে। এলএনজি এলে এই ভর্তুকি দাঁড়াবে ১০ টাকার বেশি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার বিদ্যুৎ ও সার খাতে যদি ভর্তুকি না দিত তাহলে এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়লে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। একইভাবে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এতে শত শত শিল্প কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। বেকার হয়ে যাবে হাজার হাজার কর্মচারী।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এসএম শামসুল আলম বলেন, গণশুনানিতে তারা এর তীব্র বিরোধিতা করবেন। তিনি বলেন, গ্যাস খাতের প্রতিটি কোম্পানির হাতে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে, যা দিয়ে এলএনজির বাড়তি টাকা পরিশোধ সম্ভব হবে। এই অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

শিল্প মালিকরা বলেছেন, এখন গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হলে তা কোনোমতেই শিল্প খাত সহ্য করতে পারবে না। শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে। তখন দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে, মানুষ বিদেশি পণ্য কেনার দিকে ঝুঁকবে। সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়বে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর। তারা বলেছেন, সরকার এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে শিল্প-কারখানাগুলো ধসে পড়বে। রফতানি খাত প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে। আমদানি বিকল্প স্থানীয় শিল্পপণ্য বিদেশি পণ্যের কাছে মার খাবে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version