সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় গণবাস্তুচ্যুতি ঘটে। ভারতের বিহার থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব ও গুজরাট থেকেও আসে অনেকে। তবে বিহারের অধিবাসীদের আধিক্যের কারণে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পূর্ব বাংলায় আসা এসব অবাঙালি পরিচিতি পায় বিহারি হিসেবে। এরা ছিল মূলত উর্দুভাষী।

দেশভাগের পরও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যতবারই সীমান্তে উত্তেজনা অথবা কোনো ধরনের ধর্মীয় দাঙ্গার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, ততবারই বিপুলসংখ্যক মুসলমান পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করেছে। উত্তর বিহারে তীব্র খাদ্যসংকটের জেরে সাতচল্লিশের পরও মানুষ সেখান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসে। এছাড়া সীমান্তে উত্তেজনার নানা ঘটনায়ও ওপার থেকে এদিকে সরে আসে অনেকে। ১৯৫০ সালে কলকাতার দাঙ্গার সময় অনেকে এপারে আসে। আরেকদফা উদ্বাস্তুর আগমন দেখা যায় আসামে অভিবাসীবিরোধী বিক্ষোভের সময়। ১৯৬১ সালে মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে সহিংসতা শুরুর পরও অনেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসে বসতি গড়ে। এরপর ১৯৬২ সালে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি সহিংসতার জেরেও নিরাপত্তার খোঁজে মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসী হয়। কাশ্মীরে হজরতবাল মসজিদের ঘটনায় ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় সহিংস ঘটনার জেরেও অনেকে এখানে চলে আসে।

পাকিস্তানের ১৯৫১ সালের শুমারিতে পূর্ব বাংলায় মোট ১ লাখ ১৮ হাজার উর্দুভাষী উদ্বাস্তু রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ৯৭ হাজারের বেশি ছিল বিহার থেকে আসা। অবশিষ্টদের মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার এসেছিল উত্তর প্রদেশ থেকে এবং দুই হাজার এসেছিল পাঞ্জাব অথবা দিল্লি থেকে। সে সময় অনেক উদ্বাস্তু পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে রওনা হলেও পথে দাঙ্গা বা খরচ কুলাতে না পেরে পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নেয়। ১৯৬১ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, সে সময় পূর্ব বাংলায় অবস্থানরত অবাঙালির সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৪০ হাজার।

জাভেদ হাসান (ছদ্মনাম) নামে বিহারি ক্যাম্পের এক বাসিন্দার বক্তব্য, ‘আমি কখনো পাকিস্তানে যাইনি। গত ৫০ বছরে আমি বিহারেও যাইনি। যদিও সেখানে জমিজমায় এখনো আমার অংশ রয়েছে। এখানে আসার পর থেকেই আমরা আলাদা হয়ে পড়েছি। পাকিস্তানে আমাদের মোহাজির বলে ডাকা হয়। কিন্তু এখানে আমাদের পরিচয় উদ্বাস্তু, অবাঙালি বা বিহারি নামে।’

বিহারিরা যখন পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নিতে থাকে, এখানকার শাসনক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ তখন পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী এলিটদের হাতে। ফলে ব্রিটিশদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া উর্দুভাষী সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিরা শাসকগোষ্ঠীর আনুকূল্য পেতে থাকে। ভাষাগত সুবিধাও শাসকগোষ্ঠীর কাছাকাছি এনে দেয় বিহারিদের।

এছাড়া কলকারখানার অভাব ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হওয়ায় বাঙালিদের মধ্যে দক্ষ শ্রমিক ও পেশাজীবী তখনো তৈরি হয়নি। এ সুযোগও কাজে লাগায় বিহারিরা। রেলকর্মী, কারিগর, ফোরম্যান ও কেরানি ছিল অনেক বিহারি। বিশেষ করে বিপুলসংখ্যক বিহারিকে সে সময় রেলওয়েতে চাকরি দেয়া হয়।

এ অঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকা নতুন নতুন শিল্প-কারখানায়ও শ্রমিক-কর্মকর্তা হিসেবে কাজ জুটে যায় বিহারিদের। উচ্চপদের সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় বিনিয়োগ— সবখানেই ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা পেতে থাকে বিহারিরা। ব্যাংকগুলো থেকেও তাদের ঋণ দেয়া হতো স্বল্প সুদে। পূর্ব বাংলায় এসে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেরানি, সরকারি চাকরিজীবী, শ্রমিক, চিকিৎসক ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পেশায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে তোলে তারা।

সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিকে অবজ্ঞা করে মুষ্টিমেয় বিহারির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি অভিজাতদের পক্ষপাতের পেছনে প্রধান কারণগুলোর একটি ছিল অবিশ্বাস। পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের প্রতি সন্দিগ্ধ ছিল। তারা মনে করত, বাঙালিরা আধা হিন্দু, ভারতপন্থী ও পাকিস্তানের প্রতি অনুগত নয়। বাঙালিয়ানা ঝেড়ে ফেলতে পারলেই এখানকার মানুষ সত্যিকার মুসলমান হতে পারবে বলে পাকিস্তানিরা মনে করত। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে শুধু অর্থনৈতিকভাবেই শোষণ করেনি; কেন্দ্রীয় সরকারের সব দপ্তর ও সামরিক ঘাঁটি পশ্চিম পাকিস্তানে নির্মাণের মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রযন্ত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকেও এখানকার মানুষকে বঞ্চিত করে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর এ বৈষম্যমূলক আচরণ বিহারিদের প্রতি বাঙালিদের বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্কের আবহ তৈরি করে।

বাঙালিদের মধ্যে পুঁজির বিকাশকে ভালো চোখে দেখেনি বিহারিরাও। তারা মনে করত, ছেচল্লিশের দাঙ্গায় তারা রক্ত ঝরিয়েছিল বলেই পাকিস্তানের জন্ম। উর্দুভাষীদের সঙ্গে বাঙালিদের বিভেদের বিষয়টিকে আরো উসকে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে বিহারিদের জন্য বিশেষ সুবিধাদির ব্যবস্থা করা হতো। এর ওপর তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকেও স্থানীয়দের সঙ্গে উর্দুভাষী অবাঙালিদের মেলামেশাকেও অনুৎসাহিত করা হতো। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিল বাঙালিরাও।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version