এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আগামী জাতীয় নির্বাচন কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে এবং রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কোনদিকে প্রবাহিত হবে, বৈরি বা প্রতিকূল পরিবেশ-প্রতিবেশের উদ্ভব হলে সেটি কিভাবে সামাল দেওয়া হবে—এসব নিয়ে যেন তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের। পর্যবেক্ষকদের মতে, দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ভরসা রেখে সবার মধ্যে এক ধরনের গা-ছাড়া ভাব। বর্তমানে সংসদের যারা সদস্য রয়েছেন এবং আগামী নির্বাচনে যারা দলের মনোনয়ন নিয়ে এমপি হতে চান, কারো মধ্যেই যেন তাগিদ নেই। নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় ভোটার ও সাধারণ মানুষের মন জয় করে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসার প্রস্তুতিতেও প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সার্বিক পরিস্থিতির অন্তির্নির্হিত বার্তাটি যেন এ রকম যে, গরজ শুধু প্রধানমন্ত্রীর একার, সবার ভাবখানা এমন যে তিনিই সবাইকে জিতিয়ে আনবেন।

যদিও ইতোপূর্বে দলের সংসদীয় কমিটির একাধিক বৈঠকে এবং মন্ত্রিসভার এক বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছিলেন, আগামী নির্বাচনে তিনি কারও দায়িত্ব নেবেন না। একাদশ নির্বাচন দশমের মতো সহজ হবে না, সামনের নির্বাচন কঠিন হবে, ভোটে জিততে হলে এলাকায় কাজ করতে হবে, নিজেদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিটিয়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে—প্রধানমন্ত্রীর এসব সাবধানবাণীও ব্যতিক্রম ক্ষেত্র ছাড়া কারও যেন গায়ে লাগছে না।

দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বারবার তাগিদ দিলেও ক্ষমতাসীন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে না নেওয়ার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মুজমদার শুক্রবার আলাপকালে বলেন, ‘নির্বাচনের আর কয়েক মাস অবশিষ্ট থাকলেও আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের এমন গা-ছাড়া ভাব আমরা প্রত্যক্ষ করছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা সত্য যে, তারা কেউ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। দলের জনপ্রিয়তা কতটুকু বাড়লো বা কমলো তাতে যেন তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের মধ্যে যেন এমন ধারণা জন্মেছে যে- তারা যেভাবে চাইবেন সেভাবেই নির্বাচন হবে, এজন্য এলাকায় প্রস্তুতি গ্রহণকে তারা তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না, এটা দুঃখজনক। তাছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (ওবায়দুল কাদের) বলেছেন যে- জনগণ আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে, নির্বাচন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও সেভাবে ধরে নিয়ে নিজেদের এলাকা গুছানোর বিষয়ে সিরিয়াস নন।’

প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) এরই মধ্যে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছেন যে, বিদ্যমান সাংবিধানিক হিসাবে এ বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে হিসাবে নির্বাচনের বাকি আর আট-নয় মাসের মতো হলেও রাজধানীসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগের এমপিদের বেশিরভাগেরই নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন কেন্দ্রিক তোড়জোড় তেমন নেই। ‘সামনে ভোট, দলের বিবাদ মিটিয়ে ঐক্য গড়তে হবে, ভোট পেতে আমলনামা নিয়ে ভোটারদের মুখোমুখি হতে হবে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে’- এ রকম প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত আসনওয়ারি প্রতিবেদনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের টানা এই দুই মেয়াদে বেশিরভাগ সংসদ সদস্য এলাকাবিমুখ। এই বিমুখতা বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে এমপিদের। ভোট সামনে রেখে দল গোছানো ও ভোটারদের সন্তুষ্টি অর্জনের তুলনায় বেশিরভাগ সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোযোগ ভিন্নদিকে, ভোটের বিষয়ে তারা প্রধানমন্ত্রী-নির্ভর হয়ে পড়েছেন।

অবশ্য এমনটা পুরোপুরি মানতে রাজি নন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. ক. (অব.) ফারুক খান। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আমাদের দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বড় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয় না। প্রতিটি আসনেই আওয়ামী লীগের ৫-১০ জন উপযুক্ত প্রার্থী রয়েছেন। সেজন্য তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে। তাছাড়া তিনশ আসনে আমাদের দলের কারা মনোনয়ন পাবেন সেটি প্রণয়নে দলের কেন্দ্র থেকে একটি টিম করে দেওয়া হয়েছে। সেই টিম কাজ করছে, সম্ভাব্য প্রার্থীদের সবদিক বিচার, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আমার ধারণা, প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর সবাই নিজ নিজ এলাকায় নির্বাচনের পুরো প্রস্তুতি নিতে শুরু করবেন।’

রাজনীতি পর্যবেক্ষকদের মতে, সারাদেশের আসনওয়ারি হালচালের দিকে তাকালে এটা প্রতীয়মান যে- বেশিরভাগ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতির চেয়েও আওয়ামী লীগের এমপি ও স্থানীয় নেতা-কর্মীরা পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিবাদে জড়িয়ে আছে। মাঝে-মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে দলের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের খবর আসছে গণমাধ্যমে, কোথাও কোথাও নিজেদের সংঘাতে প্রাণহানি ও রক্ত ঝরার খবরও আসছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এসব দ্বন্দ্ব-বিবাদ মেটানোর তাগিদ দিয়ে দলের এমপি-নেতাদের সতর্ক করে ইতোমধ্যে একাধিকবার বলেছেন, ঘরের ভেতর ঘর তোলা এবং মশারির ভেতর মশারি টাঙানো যাবে না। প্রতি ছয় মাস পর পর প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক এমপি ও আগামীর সম্ভাব্য প্রার্থীদের আমলনামা নিচ্ছেন। বিতর্কিতরা আগামীতে দলের মনোনয়ন পাবেন না বলেও তিনি বারবার সতর্ক করেছেন।

ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ গৃহবিবাদের সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারের বেশকিছু নির্বাচনেও। এর কয়েকদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনেও নিজেদের দ্বন্দ্বে হারতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের। এর আগে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং গাইবান্ধা-১ আসনের উপনির্বাচনেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল গৃহবিবাদ।

এসব বিষয়ে ওবায়দুল কাদের গতকাল বলেছেন, অন্তঃকলহের কারণে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী কোরামের পরাজয় হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও যেসব এলাকায় বিএনপি প্রার্থীরা জিতেছে, সেটাও আওয়ামী লীগের অন্তঃকলহের ফল। এসব বিষয় নিয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভায়ও বিস্তারিত আলাপ হয়েছে বলে জানা গেছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version