এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : চার বন্ধু- শাহীন মিয়া, তাওহীদুল ইসলাম তপু, হাফিজুর রহমান হাফিজ ও দীপ্ত সরকার। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগের চার মেধাবী শিক্ষার্থী। গত ফেব্রুয়ারিতে ফাইনাল পরীক্ষা শেষে ময়মনসিংহের ভালুকায় স্কয়ার ফ্যাশন কারখানায় ইন্টার্ন হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। প্রত্যাশা ছিল এক মাস পর বস্ত্র প্রকৌশলীর স্বীকৃতি নিয়ে বের হবেন। তারা ছিলেন নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদেরকে ঘিরেই পরিবারগুলোর মধ্যে উজ্জ্বল স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু সব আশা আর পূর্ণতার প্রত্যাশা গুড়ে বালি হয়েছে এক বিস্ফোরণে। ভালুকায় ভাড়া নেওয়া বাড়ির মালিকের নেওয়া অবৈধ গ্যাস সংযোগে তাদের জীবন প্রদীপ নিভে গেলো। ২৪ মার্চ রাতের এ বিস্ফোরণের পর একে একে সবাই মৃত্যুর কাছে হেরে যান। বিস্ফোরণের দিন ঘটনাস্থলেই মারা যান তাওহীদুল ইসলাম তপু। বাকি তিনজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার নিবির পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিত্সাধীন ছিলেন তারা। এদের মধ্যে শাহীন গত বুধবার মারা যান। হাফিজ বৃহস্পতিবার আর দীপ্ত গতকাল মারা যান।

তাদের সহপাঠী তুষার মাহমুদ জানান, ওই চারজন ছিলেন তাদের ক্লাসের মেধাবী শিক্ষার্থী। ক্লাসে দীপ্ত দ্বিতীয়, তপু তৃতীয় ও শাহীন ছিলেন চতুর্থ স্থান অধিকারী।

ঢামেক বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘শাহীনের ৮৩ শতাংশ, দীপ্তের ৫৪ এবং হাফিজের ৫৮ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। শুরু থেকেই তাদের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন ছিল। শ্বাসনালীও পুড়ে গিয়েছিল। মূলত শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়া রোগীদের বাঁচানো খুবই কষ্টকর। তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি।’

মেডিক্যালে ভর্তি দীপ্ত, শাহীন ও হাফিজের পাশের বেডের রোগীরা ও চিকিত্সকরা জানান, ২০-২৫ জন বন্ধু সর্বদা দীপ্ত, শাহীন ও হাফিজকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। রাত-দিন এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে টাকা, রক্ত ও ওষুধসহ যাবতীয় ব্যবস্থা করেও তিন বন্ধুর কাউকে বাঁচাতে পারলেন না। বন্ধুদের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে তারা চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

শাহীন সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরের মৃত নুরুজ্জামানের ছেলে। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে শাহীন ছিল দ্বিতীয়। শাহীনের ভাই শামীম হোসেন জানান, তাদের পরিবার আর্থিক দিক দিয়ে তেমন স্বচ্ছল নয়। ভাই শাহীন মাত্র পড়ালেখা শেষ করেছে। চাকরির চেষ্টাও করছিল। হয়তো পেয়েও যেতো। আমরা সবাই সেই আশাই ছিলাম। কিন্তু পরিবারের হাল ধরার আগেই সবাইকে নিরাশ করে তিনি চলে গেলেন।

দীপ্ত সরকারের গ্রামের বাড়ি মাগুড়া জেলার শালিখা উপজেলার দীঘল গ্রামে। তার বাবা নারায়ণ সরকার। পাঁচ বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে দীপ্ত সবার ছোট। ছোট হওয়ায় সবার আদরের ছিলেন। আর হাফিজের বাড়ি নওগাঁর নান্দাইলপুর গ্রামে, তার বাবার নাম মো. বিল্লাল হোসেন। তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতো পরিবারগুলো। স্বজনদের চোখে-মুখে এখন শুধু দীর্ঘঃশ্বাস।

বন্ধুদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বন্ধু নাজমুল ইসলাম বলেন, তারা ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা দশের তালিকায়। এমনকি পড়াশোনার বাইরেও তাদের আচরণ ছিল মনে রাখার মতো। সবার সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতো। তারা গরিব হলেও মনটা ছিল সুবিশাল। কখনো গরিবের মত আচরণ করেনি। তাদের ভালোবাসায় ক্লাসের সবাই সিক্ত ছিল। কথাগুলো বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ বারবার যেন চেপে আসছিল। শুধু নির্বাক চাহনি আর নয়নের নোনা জলে নিজেদের প্রচেষ্টা উপেক্ষা করে বন্ধুদের চলে যাওয়ার বেদনায় কাতরাচ্ছেন। শুধু নাজমুলই নয়। এমন দৃশ্য ঢামেক বার্ন ইউনিটের আইসিইউর সামনে অবস্থানরত আরো ২০-২৫ বন্ধুর চোখে মুখে।

তাদের আরেক বন্ধু বশির মির্জা বলেন, ‘বন্ধুরা তো বাঁচেনি। কিন্তু তাদের পরিবারগুলোকে তো বাঁচাতে হবে। আমাদের একটাই দাবি- নিহতের পরিবাররা যেন দ্রুত ক্ষতিপূরণ পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তা নাহলে কঠোর আন্দোলনে নামব আমরা।’

এদিকে, ভালুকা সংবাদদাতা জানান, রবিবার রাতেই এ ঘটনায় ভালুকা থানার এসআই কাজল হোসেন বাদী হয়ে ভবন মালিক আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা করেন। বিস্ফোরণের ঘটনায় দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে গঠিত ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট নাইরুজ্জামান। পুলিশের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এ নেওয়াজী। গতকাল তিনি বলেন, ‘বাড়ির মালিক পলাতক। পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, এসএ টাওয়ার-২ ভবনের গ্যাস সংযোগ ছিল অবৈধ। গ্যাস সংযোগে লিকেজের ঘটনায় এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এর পেছনে আর অন্য কোন কারণ জড়িত নেই। তবে তদন্ত রিপোর্ট দিতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে।’

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ভালুকা থানার ওসি মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ঘটনার পরপর বাড়ির মালিককে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির মালিক আব্দুর রাজ্জাক ঢালী তার উত্তরার বাসায় অবস্থান করছেন-এমন খবরে পুলিশ সেখানেও অভিযান চালিয়েছে।’ ওসি আরো বলেন, ‘বাড়ির মালিক স্কয়ার ফ্যাশনের ঝুট ব্যবসায়ী। এছাড়া এলাকায় তিনি জমির দালালি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ভালুকায় ৩ টি বাড়ি তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। তিনি উত্তরার নিজ বাসায় সপরিবারে থাকেন। তাকে ধরতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। বিমানবন্দর ও সীমান্তে সতর্কতাও জারি করা হয়েছে।’

অপরদিকে, খুলনা অফিস জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের চার মেধাবী শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীরসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শনিবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন দিনের শোক পালন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version