এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : সোনারঙা পাকা ধান এখন দ্যুতি ছড়াচ্ছে বিস্তীর্ণ হাওরে। ধানের ম-ম গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এ সৌরভ স্পর্শ করছে কৃষকের মনে। কিন্তু গত বছর চৈত্রের শেষ সময়ের দিনগুলো এমন ছিল না। সর্বনাশা বর্ষণ হাওরের বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব পাকা ও আধাপাকা ধান। এর সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন। ধান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন হাওরের হাজার হাজার কৃষক। এবারও সেই শঙ্কা, সেই ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। কারণ, হাওরের অনেক স্থানে বাঁধ নির্মাণ এখনও শেষ হয়নি। কোথাও কোথাও বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতিরও খবর পাওয়া গেছে। তারপরও হাওরের কৃষকরা নতুন করে স্বপ্নের জাল বুনেছেন। শুরু করেছেন ধান কাটা। মুখে ফুটেছে হাসি।

কিশোরগঞ্জ : জেলার ১৩টি উপজেলায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষি শ্রমিকরা ধান কাটতে হাওরে এসে জড়ো হয়েছেন। হাওর ও নদীর পাড় ঘেঁষে অস্থায়ী ঘর (জিরাতি বা বাথান) নির্মাণ করে কৃষি শ্রমিকরা ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করছেন। চলছে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। তবে ধানের দাম না থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষি শ্রমিকরা। কারণ, জমির মালিকের মন ভালো না থাকলে তাদেরও সুখ নেই। বাম্পার ফলন হলে আনন্দে শ্রমিকদের তিনবেলা ভালো খাবার দেওয়া হয়। এ বছর এমন হচ্ছে না। কৃষকের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে শ্রমিকদের আনন্দের হাসিও মিলিয়ে গেছে।

কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, হাওর অঞ্চলসহ সারা জেলায় এবার মোট এক লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা থেকে চাল পাওয়া যাবে ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩০ টন।

কৃষকরা জানান, কোনো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আগামী ২০ দিনের মধ্যে ৯০ ভাগ ধান তাদের ঘরে তুলতে পারবেন।

পুরানচামটা হাওরের কৃষক রুবেল মিয়া জানান, গত বছর তার ১০ একর বোরো জমির সব ধান চৈত্রের বন্যায় ভেসে গিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করেছে। এবার বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১০ একর জমিতে চাষাবাদ করেছেন। এরমধ্যে ৫ একর জমিতে বিআর-২৮ ধান ইতিমধ্যে গোলায় তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু বাজারে প্রতি মণ ধানের দাম ৬৭০ থেকে ৭০০ টাকা। অথচ উৎপাদন খরচই হয়েছে গড়ে ৮৫০ টাকা।

উপজেলা ইটনার বড়িবাড়ী গ্রামের কৃষক রাজ্জাক মিয়া জানান, সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ভালো ফলন হয়েছে। তবে বাজারে ধানের দাম খুবই কম হওয়ায় তাদের মন খারাপ।

বর্গা ও প্রান্তিক চাষিদের অবস্থা আরও খারাপ। তাদের সারা বছরের খোরাকি মেটাতে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে কৃষকরা আগামী চার দিনের মধ্যে সরকারকে ধানের সঠিক মূল্য ঘোষণার দাবি জানান।

কৃৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. সফিকুল ইসলাম ধানের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে কম এর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, দাম নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। সরকার এ বছর অবশ্যই কৃষকের কথা চিন্তা করে সঠিক মূল্য নির্ধারণ করবে।

নেত্রকোনা :গত দুই বছর অকাল বন্যায় একমাত্র বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এবার বোরোর ভালো ফলন হওয়ায় হাওর অঞ্চলের কৃষকের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। এরই মধ্যে জেলার খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জের হাওর অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ও এর আগের বছর অসময়ে হাওরে পানি আসায় হাওর অঞ্চলের ফসল রক্ষাবাঁধ ভেঙে একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যায়। এতে করে হাওর অঞ্চলের কৃষকরা একমাত্র ফসল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হন।

খালিয়াজুরীর কৃষক শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, আমাদের এলাকায় এবার ফসলের ফলন ভালোই হয়েছে। এ বছর আমি ২২ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলাম। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ক্ষতি হয়নি। এবার ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ফসল ঘরে তুলতে পারলে কয়েক বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

বারহাট্টার বাউসী ইউনিয়নের দেওপুর গ্রামের কৃষক ও মানবাধিকার নাট্য পরিষদ জেলা শাখার সভাপতি সালাহউদ্দিন খান রুবেল বলেন, আমরা কষ্ট করে ফসল আবাদ করি। কিন্তু ন্যায্য মূল্য পাই না।

হাওর উন্নয়ন পরিষদ নেত্রকোনার সভাপতি স্বাগত সরকার শুভ বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার বাঁধ সংস্কার কাজ অনেকটা ভালো হয়েছে। এ বছর ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে ফসলের বাম্পার ফলন হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ বছর এক লাখ ৮৪ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদনসহ বিভিন্ন হাওর এলাকায় আবাদ করা হয়েছে ৪১ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে, যা গত বছর ছিল প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর।

খালিয়াজুরী উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ফসলে ভরে যাবে। এলাকার কৃষকরা লাভবান হতে পারবেন।

খালিয়াজুরী উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি কৃষক তপন বাঙ্গালী জানান, অন্যান্য বছরের মতো এবার ধান কাটা-মাড়াইয়ে শ্রমিক সংকট দেখে দিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

সিলেট :এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সিলেট অঞ্চলের ১১ লাখ কৃষকের ঘরে উঠবে প্রায় ২০ লাখ টন চাল। সবকিছু ঠিক থাকলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাল উৎপন্ন হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা। তবে কিছু এলাকায় ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেওয়ায় কৃষকরা হতাশার মধ্যে রয়েছেন।

সিলেট বিভাগের চার জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় খুশি কৃষকরা। পাকতে শুরু হওয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা, বালাগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ; সুনামগঞ্জের ছাতক, জগন্নাথপুর; মৌলভীবাজারের বড়লেখা, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, নবীগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলায় বিচ্ছিন্নভাবে ধানকাটা শুরু হয়েছে।

সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আলতাবুর রহমান বলেন, এবারের ফসলের অবস্থা ভালো। কয়েকদিনের মধ্যে পুরোদমে ধানকাটা শুরু হবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপন্ন হবে। তিনি জানান, তাহিরপুরসহ কিছু এলাকায় পানি থাকায় ধান পাকতে আরও ১০-১৫ দিন সময় লাগবে। ধানে ব্লাস্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে তা হয়েছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ওষুধ দেওয়া হয়েছে।

সুনামগঞ্জ :”২৮ ধান কিছু কাটলাম, যদি সপ্তাহ্‌-দশদিন আল্লায় দিন ঠিক রাখইন, ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত না হয়, তাইলে ‘ধুম্বইল’ (আনন্দ-উল্লাস করে) দিয়া এইবার ধান কাটমু। কাছির ভারি শুরু হলে ধান আরও তাড়াতাড়ি পাকবো।” শুক্রবার দুপুরে দেখার হাওরে ধান কাটতে কাটতে কথাগুলো বলছিলেন হাওরপাড়ের জলালপুর গ্রামের কৃষক জামাল উদ্দিন।

জমির পাকা ধানে কাচি টান দিতে দিতে হাওরপাড়ের সচিন্দ্র কুমার দাস বলেন, ‘গতবার তো ধানের গোটা দেখছি না, এইবার ধানও হাত লাগাইছি। গতকালকে কিছু ২৮ ধান কাটছি, আজকেও কাটলাম, এর মধ্যে এক মণ ধান এক হাজার টাকায় বিক্রিও করেছি।’ তিনি জানান, দেখার হাওরে এইবার ২৮ ধান প্রতি একরে ৩০ থেকে ৩২ মণ হবে। ২৯ ধান হবে প্রতি একরে ৪৫ থেকে ৪৭ মণ।

এই হাওরে শুক্রবারই প্রথম ধান কাটতে এসেছেন হাওরপাড়ের সাধকপুরের কৃষি শ্রমিক মনির মিয়া। ৬ ভাগের এক ভাগ চুক্তিতে ধান কাটছেন তিনি। মনির মিয়া বললেন, ‘একদিনে এক মণের মতো পাইমু। আল্লায় যদি বৈশাখী দেইন, এক মাসে ২৫-৩০ হাজার রোজগার করমু।’

হাওরপাড়ের জলালপুরের কৃষক ফজলু মিয়া জানালেন, এবার ধান ভালো হয়েছে, খুব বেশি বৃষ্টি না হলে ১৫ দিনের মধ্যেই বেশিরভাগ ধান কেটে আনা যাবে।

জামালগঞ্জ ও বিশ্বম্ভরপুরের হালির হাওরের উঁচু অংশে, জগন্নাথপুরের মইয়ার হাওর, নলুয়ার হাওর ও পিংলার হাওর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ঢুকলাখাই, পাগলার দক্ষিণের হাওর, কাচিভাঙা হাওর, রাঙামাটি ও নাগডরা হাওরে ধান কাটার উৎসব শুরু হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক স্বপন কুমার সাহা বললেন, সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় এবার ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮ লাখ ৯৩ হাজার টন। এবার ফলন যেভাবে হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। সূত্র : সমকাল

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version