এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : প্রকল্পে বৈদেশিক সহায়তা বাড়ছে। কিন্তু তা খরচ করা যাচ্ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে, বৈদেশিক অর্থায়ন খরচে অনীহা বাড়ছে। গত অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তার প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এভাবে প্রতি বছরই বিপুল অংকের বৈদেশিক সহায়তা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। এ কারণে অর্থের পাহাড় জমছে পাইপলাইনে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থ ব্যয়ে দাতাদের বিভিন্ন শর্ত পালনের পাশাপাশি শতভাগ স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা থাকায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এতে নিরুৎসাহিত হন। এ ছাড়া বৈদেশিক অর্থায়নে অপচয়, অপব্যবহার আর দুর্নীতির সুযোগ থাকে কম, যা অর্থ ব্যয় না হওয়ার অন্যতম একটি কারণ।

অপরদিকে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেশীয় অর্থায়নে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা খরচে কার্পণ্য দেখালেও সরকারি অর্থ খরচে আগ্রহ দেখাচ্ছেন অত্যধিক। কারণ এখানে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা তুলনামূলক অনেক কম। দুর্নীতি-অনিয়মের সুযোগ থাকে বেশি। এ কথা স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযমের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড় পেতে হলে অনেকগুলো প্রক্রিয়া পার করতে হয়। অর্থাৎ সরকার ও উন্নয়ন সহযোগী দু’পক্ষের অনেকগুলো শর্ত থাকে। এসব শর্ত পূরণ করেই অর্থ পেতে হয়। তাই তাড়াহুড়ো কিংবা শর্টকাট প্রক্রিয়ায় এই টাকা খরচের সুযোগ নেই। উদ্দেশ্য ভালো হলেও নিয়মকে পাশ কাটিয়ে কেউ যেতে পারবেন না। অন্যদিকে সরকারি অর্থে এ রকম কোনো বাধা নিষেধ বা তৃতীয় পক্ষ থাকে না। তবে সরকারি অর্থ ব্যয়ে অনেক সময় কেনাকাটার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তিনি জানান, বর্তমানে পাইপলাইনে জমা অধিকাংশই সস্তা সুদের ঋণ। এই সুযোগ তো সবসময় থাকবে না।

বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থায়ন যাছাই করে দেখা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে আকর্ষণ বাড়ছে সরকারের নিজস্ব তহবিলের প্রতি। এর কারণ হিসেবে বিশেজ্ঞরা বলছেন, বৈদেশিক ঋণের অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে নানা প্রক্রিয়া সমাপ্ত করতে হয়। এতে আছে ধাপে ধাপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। এ ছাড়া দুর্নীতি, অনিয়মের সুযোগ প্রায় থাকেই না। পাশাপাশি প্রকল্প পরিচালকদের অদক্ষতা, ইংরেজি ভাষায় পশ্চাৎপদতা এবং সক্ষমতার অভাব ইত্যাদিও অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত। এ কারণে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর চাপ বাড়ছে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছরই সংশোধিত এডিপিতে কমানো হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের বরাদ্দ। যেসব প্রকল্পে বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহার করা যাচ্ছে না সেসব প্রকল্পের পরিচালকরা কোনো জবাবদিহিতার আওতায় আসছেন না। ফলে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে বছরের পর বছর। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, বৈদেশিক সহায়তার অর্থ পাওয়া যায় একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এখানে জবাবদিহিতা বেশি থাকে, যা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের পছন্দ নয়। আর সরকারি অর্থে তুলনামূলক জবাবদিহিতা কম থাকে বলে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। ফলে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। ব্যয় বাড়ে কিন্তু প্রকল্প থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফল আসে না। অন্যদিকে দাতারাও সহায়তা দিতে নিরুৎসাহিত হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ খরচ না হলেও সরকারি তহবিলের এ পরিমাণ টাকা খরচ করা গেছে ঠিকই। অর্থাৎ বৈদেশিক অংশ থেকে বাদ গেলেও সরকারি তহবিলের অর্থে সমপরিমাণ টাকা ঠিকই বরাদ্দ রাখা হয়। এই অনীহার কারণে বৈদেশিক সহায়তার অর্থের পাহাড় জমছে পাইপলাইনে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত পাইপলাইনে জমা হয়েছে ৪ হাজার ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩ লাখ ২২ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫৭৪ কোটি ডলার বা প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে পাইপলাইনে জমা হয়েছে আরও ৪৬০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ চিত্র।

সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরের বৈদেশিক সহায়তার চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ ছিল ৫৭ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু খরচ করতে না পারায় সেখান থেকে ৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা কাটছাঁট করে বরাদ্দ বাদ দিতে হয়েছে। ফলে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা ফেরত দেয় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। ফলে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হয় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ ছিল ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সেখান থেকে ৫ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা খরচ করতে না পারায় বরাদ্দ কমিয়ে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হয় ২৯ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে গত কয়েক বছরের বৈদেশিক অর্থ ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, গত ২০১২-১৩ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া বৈদেশিক সহায়তার মধ্যে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে মাত্র ৮৯ শতাংশ। এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে খরচ করে ৮৯ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯০ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খরচ হয়েছে বরাদ্দের ৭৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। যদিও প্রতি অর্থবছরে টাকার অংকে খরচের হার বেড়েছে। কিন্তু বরাদ্দ অনুপাতে সেটি কমছে। অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিতেও কমছে বৈদেশিক সহায়তার অবদান। এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রকল্প পরিচালক ও বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা তার অভিজ্ঞতা থেকে জানান, মূলত চুক্তির নানা নিয়ম-কানুন মানতে হয় বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রে। যেমন কেনাকাটা করতে গেলে ধাপে ধাপে দাতা সংস্থার সম্মতি নিতে হয়। একটি প্যাকেজের ঠিকাদার নিয়োগ-সংক্রান্ত কাজে ৩-৪ বার তাদের কাছে যেতে হয়। অর্থছাড়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version