এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি এবং পাসের হারে মেয়েরা অনেক আগেই ছেলেদের ছাড়িয়ে গেছে। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বেড়েছে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ। বর্তমানে দেশে মোট কর্মসংস্থানে নারীর উপস্থিতি ৩১ শতাংশের বেশি। কিন্তু দেশের ব্যাংকিং খাতে চাকরির ক্ষেত্রে নারীরা এখনো বেশ পিছিয়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের ৫৭টি তফসিলি ব্যাংকে কর্মরত মোট জনবলের মাত্র ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ নারী। তবে ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের পর্যায়ভেদে নারীর উপস্থিতিতে তারতম্য রয়েছে। প্রারম্ভিক বা সূচনা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ নারী ব্যাংকার কর্মরত রয়েছেন। ব্যাংকের মধ্যবর্তী পর্যায়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপক পদে কর্মরতদের ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ নারী। তবে উচ্চপর্যায়ে নারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতি সবচেয়ে কম। ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পর্যায়ে এবং তারও উপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ নারী। যদিও দেশের সার্বিক জনসংখ্যার মধ্যে নারীই অর্ধেকের বেশি।

গত বছর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশী ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ব্যাংকার। এর মধ্যে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ নারী হলে সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৭৫। নারী ব্যাংক কর্মকর্তাদের এ সংখ্যা কর্মক্ষেত্রে লৈঙ্গিক সমতার বিপরীত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সমাজ বাস্তবতার কারণেই দেশের ব্যাংকিং খাতে নারীদের অংশগ্রহণ কম।

এ প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান বলেন, আগে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম ছিল। যারা পড়াশোনা করতেন, তারাও পুরোপুরি সংসারমুখী ছিলেন। সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও নারীরা অনেক ক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে আসতেন না। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন শিক্ষিত নারীরা পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। আমি নিজেও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে অন্তত একজন নারী উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নিয়োগ দিতে চাই। কিন্তু যোগ্য প্রার্থী না থাকায় এটি সম্ভব হচ্ছে না। ১০ বছর পর পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। তখন অনেক ব্যাংকে শীর্ষ নির্বাহী হওয়ার মতো যোগ্য নারী ব্যাংকার পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোর মধ্যে নারী কর্মকর্তার গড় উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি বিদেশী ব্যাংকগুলোয়। এসব ব্যাংকে প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারী কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ ২৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। মধ্যবর্তী পর্যায়ে এ হার ১৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। বিদেশী ব্যাংকগুলোয় উচ্চপর্যায়ে কর্মরতদের মধ্যে নারী কর্মকর্তা ১৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।

সংখ্যার হিসাবে ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বেশি নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয়। তবে নারী কর্মকর্তাদের চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে এ ব্যাংকগুলো। দেশের বেসরকারি খাতের ৪০টি ব্যাংকে প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারী কর্মকর্তা ১৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। মধ্যবর্তী পর্যায়ে নারী রয়েছেন ১৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকে উচ্চপর্যায়ে নারী কর্মকর্তা ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

দেশের ৫৭টি তফসিলি ব্যাংকের কোনোটিরই শীর্ষ নির্বাহী পদে নারী ব্যাংকার নেই। তবে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) পদে নতুন প্রজন্মের মেঘনা ব্যাংকে জোহরা বিবি, ডিএমডি পদে এবি ব্যাংকে শামসিয়া আই মুতাসিম ও একই পদে সিটি ব্যাংকে মাহিয়া জুনেদ কর্মরত রয়েছেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় প্রারম্ভিক পর্যায়ে যোগদানকারীর ১৫ দশমিক ৪০ শতাংশই নারী কর্মকর্তা। এ ব্যাংকগুলোর মধ্যবর্তী পর্যায়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ পদে ও উচ্চপর্যায়ে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ পদে নারীরা কর্মরত রয়েছেন। কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী পদে নারী ব্যাংকার না থাকলেও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের এমডি পদে দায়িত্ব পালন করছেন কৃষি ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মাহ্তাব জাবিন।

ব্যাংকারদের মধ্যে নারীর কম উপস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকিং অনেকটা মার্কেটিং রিলেটেড জব। এটি সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং। এ খাতে নারীর উপস্থিতি এজন্য কম হতে পারে। নিজের ক্যারিয়ার প্রসঙ্গে মাহ্তাব জাবিন বলেন, সারা জীবন আমাকে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গেই চাকরি করতে হয়েছে। শীর্ষ নির্বাহী হতে হলে পদোন্নতির অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই একজন নারী ব্যাংকারের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। কোনো ব্যাংকের এমডি পদে নারীর উপস্থিতি না থাকার এটিও একটি কারণ হতে পারে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাতে নারীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির চিত্র উঠে এসেছে। বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোয় কর্মরত ৩০ বছরের কম বয়সী জনবলের ২০ দশমিক ৪৪ শতাংশ নারী। ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী ব্যাংকারদের মধ্যে নারী ১৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তবে ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে নারী ব্যাংকার মাত্র ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

ব্যাংকে কর্মসংস্থানে নারীরা যতটা পিছিয়ে, সে তুলনায় ব্যাংকগুলোর পর্ষদে তাদের উপস্থিতি বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৭ সাল শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের মধ্যে ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ নারীর উপস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ নারী পর্ষদ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয়। এছাড়া ১২ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে ও ১৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ নারী বিদেশী ব্যাংকগুলোর পর্ষদে দায়িত্ব পালন করছেন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version