এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আমে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে ভিটামিন সি ও আঁশ কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। বিশেষ করে দেহের জন্য ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বা নিম্নঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা অপরিসীম। এ দুটি উপাদানই বেশি মাত্রায় পাওয়া যায় ল্যাংড়া আমে। সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রোটিন ও সোডিয়ামও রয়েছে ল্যাংড়াতেই।
অস্বাভাবিক হূদস্পন্দন ও রক্তচাপ প্রতিরোধে ভূমিকা রয়েছে আমে বিদ্যমান খনিজ উপাদান পটাশিয়ামের। অম্লত্ব দূর করে দেহে পিএইচের মাত্রাও স্বাভাবিক রাখে ফলটি। এসব উপাদান তুলনামূলক বেশি মাত্রায় পাওয়া যায় গোপালভোগে। পাশাপাশি আমটিতে রয়েছে পর্যাপ্ত এডিবল প্রোটিন, টাইট্রাটেবল অ্যাসিডিটি এবং ক্যালসিয়াম।
সব আমেই পুষ্টি উপাদান কম-বেশি থাকলেও কোন জাতে কী মাত্রায় পাওয়া যায়, তা নিয়ে গবেষণা করেছে একদল গবেষক। প্রধান দশটি জাতের আমের নমুনা সংগ্রহের পর তা বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করেছেন তারা। ইন্টারন্যাশনাল ফুড রিসার্চ জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল বলছে, পুষ্টিগুণ বিবেচনায় ল্যাংড়া ও গোপালভোগ আম আছে সবার ওপরে। আম্রপালিতে সব ধরনের পুষ্টি ও খনিজ গুণ থাকলেও সুগারের পরিমাণ কিছুটা বেশি। সবগুলো পুষ্টি ও খনিজ উপাদান মধ্যম মাত্রায় রয়েছে চোষা আমে। ল্যাংড়া ও গোপালভোগের মতো না হলেও ভালো পুষ্টিগুণ রয়েছে হিমসাগর, ফজলি ও ক্ষীরশাপাতসহ অন্যান্য আমেও।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রওশন আরা এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রত্যেকটি আমই তার স্বতন্ত্র গুণে গুণান্বিত। গবেষণাটি করা হয়েছে মূলত কোন আমে কী ধরনের পুষ্টি ও খনিজ উপাদান রয়েছে, সেটি যাচাইয়ে। সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ যাতে তার প্রয়োজন অনুসারে আমের পরিভোগ করতে পারে। পাশাপাশি নীতিনির্ধারকরা এর আবাদ সম্প্রসারণে ভূমিকা নিতে পারেন। আম্রপালি আমে সব ধরনের গুণ থাকলে একটু বেশি মিষ্টি। ফলে উচ্চ রক্তচাপে যারা ভুগছেন, তারা আমটি পছন্দ নাও করতে পারেন। তবে স্বাভাবিক মানুষের কাছে এটি বেশ পুষ্টিকর ফল হতে পারে। আবার চোষা আমটি সব ধরনের পুষ্টিগুণ স্বাভাবিক মাত্রায় রয়েছে। তবে সার্বিক পুষ্টি বিবেচনায় ল্যাংড়া, গোপালভোগই সবচেয়ে বেশি খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ।
আমে বিদ্যমান উপাদানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— প্রোটিন, ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি৬ ও অন্যান্য ভিটামিন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আঁশ, ক্যালরি, সোডিয়াম ও কার্বোহাইড্রেট। যে ১০টি জাতের আম নিয়ে গবেষণা হয়েছে তার ফলাফল বলছে, গোপালভোগ আমের গড় ওজন প্রায় ২২০ গ্রাম। অত্যন্ত রসালো আমটির গড় মিষ্টতার পরিমাণ ২২ দশমিক ৬ ও খাদ্যাংশ ৬০ শতাংশ। আমটি আঁশবিহীন, শাঁস গভীর, রঙ কমলাভ, খোসা সামান্য পুরো কিন্তু আঁটি পাতলা। অন্যদিকে ল্যাংড়া আম অত্যন্ত রসালো ও মিষ্টতার পরিমাণ গড়ে ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ। আমটির বোঁটা চিকন ও আঁটি অত্যন্ত পাতলা। ল্যাংড়ায় খাওয়ার উপযোগী অংশ গড়ে ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ ও গড় ওজন ৩২০ গ্রাম।
এসব উপাদানের কারণে আম ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি প্রতিরোধ করা থেকে শুরু করে ওজন হ্রাস, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি, হজমশক্তি বৃদ্ধি, এমনকি ত্বকের পরিচর্চায় কার্যকর ভূমিকা রাখে বলে জানান সংশ্লিষ্ট গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এএনএম ফখরুদ্দিন। তিনি বলেন, রক্তশূন্যতা, কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ, দাঁত ও মাড়ির সুস্থতা ও চোখের জ্যোতি বাড়াতেও আমের ভূমিকা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সব আমেই কম-বেশি আছে। তবে বিশেষ কিছু উপাদান কয়েকটি আমেই বেশি রয়েছে। সেদিক থেকে ল্যাংড়া, গোপালভোগ, চোষা ও ফজলিই সেরা।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, অন্যান্য জাতের মধ্যে চোষা আমে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামের উপস্থিতি রয়েছে। আমটিতে চিনির পরিমাণ তুলনামূলক কম। আবার আম্রপালি আমে সবচেয়ে বেশি কার্বোহাইড্রেট পাওয়া গেছে। আর হিমসাগরে বেশি পাওয়া গেছে ভিটামিন সি। চিনির পরিমাণ সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে ফজলি আমে। মল্লিকা আমে সল্যুবল সলিডস পাওয়া গেছে তুলনামূলক কম।
১০টি আম নিয়ে গবেষণাটি করা হলেও দেশে আমের প্রজাতি রয়েছে শতাধিক। এর মধ্যে টিকে আছে ৫০টির মতো জাত। এসব জাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরশাপাত (গোপালভোগ), হিমসাগর, আম্রপালি, মল্লিকা, লক্ষ্মণভোগ, মোহনভোগ ও বোম্বাই এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এছাড়া দেশে গবেষণার ভিত্তিতে উদ্ভাবিত আমের উন্নত চারটি জাত হচ্ছে বারি-১, বারি-২, বারি-৩ ও বারি-৪। দিনাজপুরের সূর্যপুরীরও সুখ্যাতি আছে।
মৌসুমি ফল হিসেবে আমের প্রাপ্যতাও অন্যান্য ফলের তুলনায় ভালো। দেশে প্রায় এক লাখ একর জমিতে এখন আমের উৎপাদন প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন। দেশের প্রায় সব জেলায়ই আম উৎপাদন হলেও সবচেয়ে বেশি আবাদ হচ্ছে বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, যশোর, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রামভুক্ত জেলায়। উপকূলীয় লবণাক্ত ভূমিতেও এখন মিষ্টি আমের চাষ হচ্ছে। কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) তথ্য বলছে, বৈশ্বিক আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম।