ওয়াহিদুজ্জামান, ফ্রান্স থেকে : “মরণ বাঁধ ফারাক্কা, গুঁড়িয়ে দাও, ভেঙ্গে দাও।” ৯৬ বছর বয়সী মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর বজ্রকণ্ঠের গগন বিদারী যে আওয়াজ আজ থেকে ৪৪ বছর আগে উঠেছিল তা এখনো আকাশে বাতাসে আন্দোলিত হয়।
১৬ মে ছিল সে দিনটি । কত নীরবেই না চলে গেল দিবসটি। ১৯৭৬ সালের এদিনে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দানে ফারাক্কা লংমার্চ শুরুর পূর্বক্ষণে লাখো জনতার সমাবেশে ভারতের পানি আগ্রাসী নীতির প্রতিবাদে এ শ্লোগান নিয়ে গর্জে উঠেছিলেন মওলানা ভাসানী। দিনটি ‘‘ফারাক্কা দিবস’’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দূরদর্শী নেতা মওলানা ভাসানী তখনই বুঝতে পেরেছিলেন ফারাক্কা বাঁধের কি ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হবে। তাইতো ভারতের পানি শোষণ নীতির বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বলেছিলেন ফারাক্কা চল ‘লংমার্চে’। তখন এতো ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকলেও সারাদেশ থেকে দেশপ্রেমিক হাজার হাজার মানুষ ছুটে এসেছিল রাজশাহী। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। যারা অতীত স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান, তাদের কথা হলো এমন স্বতঃস্ফূর্ত লংমার্চ আর কখনো হয়নি। মাওলানার ডাকে প্রাণের টানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষ জড়ো হয়েছিল রাজশাহীতে। ফারাক্কা অভিমুখী লংমার্চের সময় খাবার ছিল সামান্য চাল ডালের খিচুড়ী, চিড়া-গুড়-মুড়ি। স্থানীয়রা রুটি, পানিসহ যেভাবে যে পেরেছে লংমার্চের কাফেলাকে স্বাগতম জানিয়েছে। এটি ছিল দেশপ্রেমের অনন্য এক নজির । রাজশাহী থেকে শিবগঞ্জের কানসাটের ৭০ কিলোমিটার পদযাত্রা খুব সুখময় ছিল না। কখনো প্রচন্ড খরতাপ আবার কখনো ঝড় বৃষ্টির ঝাপটা মোকাবেলা করতে হয়েছে। সবকিছু উপেক্ষা করে লংমার্চ এগিয়েছে। যার অগ্রভাবে ছিলেন দাঁড়িটুপিওয়ালা,পায়জামা কখনো সফেদ লুঙ্গি পাঞ্জাবীর চির পরিচিত পোশাক পরিহিত মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী। প্রকাশ্যে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এ লংমার্চে পেছন থেকে অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি মাওলানা ভাসানীর এ ইস্যুকে জাতিসংঘ পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। মাওলানা ভাসানী ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করে দিল্লীর শাসকদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও তার লংমার্চ ফারাক্কা ব্যারাজ হতে কয়েক মাইল দূরে কানসাটে শেষ হয়েছিল। তাতেই ভয়ে ভারত সরকার এ সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছিল।
মাওলানা ভাসানী তার সমাপনী বক্তব্যে বলেছিলেন, ভারতের জানা উচিত বাংলাদেশের মানুষ আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না। তিনি মজলুম জনতার আর্তনাদে সাড়া দিয়ে আলাপ – আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানান। এতে ব্যর্থ হলে গোটা দুনিয়ার মানুষ ভারতের পানি আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, গঙ্গার পানি চাই। এটা আমাদের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার আমরা আদায় করে ছাড়বো। আফসোস! লংমার্চের ৬ মাস পর ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান সেই মহানপুরুষ। মওলানা ভাসানীর লংমার্চের পর ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ৫ বছর মেয়াদী পানিবণ্টন চুক্তি করে। বিগত হাসিনা সরকারের আমলেও ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি করে। কোনো গ্যারান্টি ছাড়া। পরিতাপের বিষয়, ভারত সরকার কোনো চুক্তির মর্যাদা দেয়নি। চুক্তি মোতাবেক পানি বাংলাদেশ কখনো পায়নি। বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত রেখেই ক্ষ্যান্ত হয়নি। তার পানি শোষণ নীতি আরো আঁটোসাঁটো করেছে। উজানে অসংখ্য স্থাপনা করে পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। যার পরিণতিতে এপারের বাংলাদেশের পদ্মা নদীসহ অসংখ্য নদনদী, খালবিল অস্তিত্ব হারিয়েছে। প্রমত্ত পদ্মা নামের নদীটি এখন শীর্ণখালে পরিণত। পদ্মা নামে নদীটি পানির নীচে চাপা পড়ে ফসিলের রূপ নিয়েছে। হারিয়েছে জীব – বৈচিত্র্য। আবহাওয়ায় ভর করেছে রুক্ষতা । পদ্মা পাড়ের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন জীবিকা আজ বিপন্ন। এক দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যদিয়ে দিন পার করছে এ অঞ্চলের মানুষ। শুধু ফারাক্কা নয় ; গজল ডোবা, টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে গোটা দেশের মানুষকে ধ্বংস করার উন্মত্ত নেশায় মেতে উঠেছে ভারত। এমন ভয়াবহ অবস্থায় ভারতের তাবেদার সরকারতো বটেই। কথিত দলকানা পোষমানা সুশীলরাও এনিয়ে কথা বলতে চান না। পাছে যদি দাদা – দীদিরা নাখোশ হয়। গতকাল ফারাক্কা দিবস হলেও তাদের মুখে ‘‘রা’’ ছিল না । তেমন কোনো কর্মসূচিও চোখে পড়েনি । বেশির ভাগ মিডিয়ায় উপেক্ষিত ছিল দিনটি। কারণ একই। এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দেশপ্রেমিক হাতে গোনা ক’টি গণমাধ্যম সামান্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছে দিনটির কথা। সচেতন বুদ্ধিজীবীরা ঘরোয়াভাবে আলোচনার মধ্যদিয়ে ইতি টেনেছেন। কি করবেন? দলকানা পোষমানাদের সংখ্যাই যে বর্তমানে ঢের বেশি!
দেশের নানা ক্রান্তিকালের সঙ্গে আজও গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণে করছি মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কথা। দেশের বর্তমান ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে তার মত নেতার বড্ড প্রয়োজন। আল্লাহ আপনাকে জান্নাতবাসী করুক। আমীন।
লেখক : ফ্রান্স প্রবাসী

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version