এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : দশ হাতে মার খাচ্ছে সিরীয়রা। কে কোন দিক থেকে হামলা করছে তা বুঝে উঠতে পারছে না। মুহুর্মুহু মর্টারের সেল আর অবিরাম বিমান হামলায় দিশেহারা অবস্থা। একদিন-দু’দিন নয়, গত সাত বছর ধরে চলছে এই দুর্দশা। প্রথমে সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে শুরু হলেও যুদ্ধ এখন আর এই দু’পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সরকারি বাহিনীর পক্ষে হামলা চালাচ্ছে রুশ বাহিনী, ইরান ও লেবাননের হেজবুল্লাহ। আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে বিদ্রোহীরা। তাদের সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিমা দেশগুলো। হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলও। এভাবে বহু পক্ষীয় হামলার মাঝে পড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে অসহায়-নিরুপায় জনগণ। রাকা, হোমস ও ঘৌটার পর বিদ্রোহীদের শেষ ঘাঁটি ইদলিবেও পুনর্দখল অভিযান চালাচ্ছে আসাদ বাহিনী। এর মধ্যে দিয়েই এ যুদ্ধের শেষ হবে। মঙ্গলবার থেকে ইদলিবে যৌথ হামলা শুরু করেছে সরকারি ও রুশ বাহিনী। এ হামলায় এখন পর্যন্ত ১০ বেসামরিক নিহত হয়েছেন। খবর বিবিসি ও এএফপির।
হামলায় লাখ লাখ নাগরিক হতাহত হতে পারে বলে মঙ্গলবার রাশিয়াকে হুশিয়ারি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে সেখানে রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে জাতিসংঘ। নতুন এক হুশিয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, হামলায় রাসায়নিক গ্যাস ব্যবহার করতে পারে আসাদ বাহিনী। ফের যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে ‘দ্রুতই’ তার জবাব দেয়া হবে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানও ওয়াশিংটনের হুশিয়ারি প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বলেছেন, ইদলিবে রুশ বাহিনীর বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ‘গণহত্যা’ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের
বিরুদ্ধে শুরু হওয়া শান্তি গণঅভ্যুত্থান দেখতে দেখতে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। যুদ্ধে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার বেসামরিক নাগরিক। গুরুতর জখম হয়েছে ১০ লক্ষাধিক মানুষ। উদ্বাস্তু হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ নাগরিক।
যেভাবে বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধের শুরু : ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদ মারা যান। উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতায় আসেন বাশার। তার শাসন আমলে উচ্চ বেকারত্বের হার, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাবে সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হতে থাকে সিরিয়ার জনগণ। ঠিক সেই সময় প্রতিবেশী দেশগুলোয় আরব বসন্তের ঢেউ আছড়ে পড়ে দামেস্কেও। ২০১১ সালের মার্চে আন্দোলনের বন্যা নামে সিরিয়ায়। দমন-পীড়ন শুরু করে সরকার। ফল হয় হিতে বিপরীত। ক্ষেপে ওঠে গণতন্ত্রপন্থীরা। চূড়ান্ত আকার ধারণ করে বাশার পতন বিক্ষোভ। ভাব খারাপ দেখে আন্দোলন থামাতে আন্দোলনকে ‘বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করে বিরোধীদের ওপর সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকে। একপর্যায়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন সশস্ত্র রূপ নেয়।
যুদ্ধে যার পক্ষে যার অবস্থান : সিরিয়ার যুদ্ধ প্রথমে আসাদপন্থী ও আসাদবিরোধীদের মধ্যে শুরু হলেও এখন আর তা এই দু’পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমের বহু গোষ্ঠী ও দেশ নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন এজেন্ডা নিয়ে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। এতে সেখানকার পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।
দেশটির প্রধান দুই ধর্মীয় গোষ্ঠী শিয়া ও সুন্নির মধ্যে বনিবনা ছিল না কোনো কালেই। সেই ফাঁকে সিরিয়াকে ভাঙার ষড়যন্ত্রে মাতে বিদেশি শক্তিগুলো। শিয়াপন্থী বাশারের বিরুদ্ধে তারাই উসকে দেয় সুন্নিপন্থীদের। পশ্চিমাদের খপ্পরে পড়ে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো। অবশেষে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উভয় গোষ্ঠী একে অপরের ওপর নিধনযজ্ঞ শুরু করে। এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়কে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে। এর মাঝে বিদেশিদের ষড়যন্ত্রে আল কায়দা ও আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান হয়। স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সিরিয়ার কুর্দি গোষ্ঠীও যোগ দেয় যুদ্ধ নৃত্যে। পরবর্তী সময় তুরস্ক সরকারবিরোধী এই গোষ্ঠীর ছুঁতো ধরে যুদ্ধে নামে তুরস্কও।
প্রধানত সরকারি বাহিনীর প্রধান সমর্থক ও সহযোগীর মধ্যে রয়েছে ইরান ও রাশিয়া। অন্যদিকে বিদ্রোহীদেরকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও সৌদি আরব। যুদ্ধের প্রায় তিন বছর পর ২০১৫ সালে আসাদের পক্ষে বিদ্রোহী বাহিনীর ওপর বিমান হামলা শুরু করে রুশ বাহিনী। আসাদের পক্ষে যুদ্ধে কয়েক হাজার ইরানি যোদ্ধা। এছাড়া ইরানি সহায়তাপুষ্ট লেবাননের হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীও সরকারি বাহিনীকে সহযোগিতা করছে।