অ্যান্তোনিও গুতেরেস : জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের দুঃখজনক মৃত্যুর পর থেকে আমার মধ্যে ভাবান্তর হচ্ছে, ঠিক কোন বিষয়টি তাকে এমন বিশেষ ব্যক্তিত্ব বানিয়েছে। আমার মন বলছে, সাধারণভাবে বিষয়টি হল- কফি ছিলেন দয়ালু এবং আমাদেরই একজন।

তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী বিশ্বনেতা। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন কার্যত এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাকে বিশ্ববাসী এবং ভিকটিম মানুষ খুঁজে পেতে পারে- দূরদূরান্তের দারিদ্র্যসীমায় বাস করা মানুষ, সংঘর্ষ ও হতাশা আক্রান্ত মানুষ তাকে পেয়েছিলেন একজন মিত্র হিসেবে; জাতিসংঘের কর্মীরা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন এবং ওইসব তরুণও করছেন, নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত যাদের তিনি বলেছেন, ‘সব সময় মনে রাখবে, তোমরা একেবারে এমন ছোট নও যে কখনও নেতৃত্ব দিতে পারবে না এবং আমরাও এমন কোনো বয়স্ক নই যে আর শিখতে পারব না’।

আমাদের সময়ের সামান্য কিছু মানুষের মতো কফি মানুষকে একত্র করতে পারত, তাদের স্বস্তিতে রাখতে পারত এবং লক্ষ্যের দিকে তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারত।

বহু প্রচলিত একটি জোক আছে- কূটনীতির সূত্র হচ্ছে কোনো কিছু না বলা, বিশেষত যখন তুমি কথা বলছ। কফি আনান সবকিছু বলতে পারতেন, মাঝে মাঝে একটি শব্দও উচ্চারণ করা ছাড়াই। এটি অর্জিত হয়েছে তার নিজের গভীরে প্রোথিত মর্যাদা, নৈতিক দৃঢ়প্রত্যয় এবং মানবতা থেকে।

তার মাঝে এমন ভদ্র কণ্ঠ ছিল, এমন ললিত সুর ছিল যা মানুষের মধ্যে হাসি ফুটিয়েছে এবং গানের বিষয়ে তাদের ভাবিয়েছে। কিন্তু তার স্বরগুলো ছিল কঠোর এবং প্রাজ্ঞ। আর মাঝে মাঝে ছিল এমন- পরিস্থিতি যত গুরুগম্ভীর হতো, তত হালকা শব্দ পাওয়া যেত তার কাছ থেকে। শুনে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়তাম। বিশ্বও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ত। আসলে তার প্রজ্ঞার দ্বারা আমরা হয়েছিলাম পুরস্কৃত।

কফি ছিলেন সাহসী, ক্ষমতাসীনদের সামনে সত্য বলতেন, এমনকি যখন তার তীব্র আত্মপরীক্ষার প্রশ্ন থাকত, তখনও। দাগ হ্যামারশোল্ড এবং নিজের পূর্বসূরি অন্যান্য জাতিসংঘ মহাসচিবের মতো অন্যায়ের এক বিশ্বে ভালোর একটি শক্তি হিসেবে জাতিসংঘের ভূমিকা সম্পর্কে প্রায় রহস্যময় একটি বোধ কফির মধ্যেও ছিল। এসবই তার উল্লেখযোগ্য অর্জনের রেকর্ডকে সমৃদ্ধ করেছে।

মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস (এমডিজি) এবং নিজের প্রতিবেদন ‘ইন লার্জ ফ্রিডম’-এ ঐতিহাসিক সংস্কারসহ বহু নতুন আইডিয়া ও উদ্যোগের অগ্রদূত ছিলেন তিনি।

পরিবেশ সংরক্ষণ, মানবাধিকার রক্ষা এবং এইচআইভি/এইডস ও অন্যান্য জীবননাশকারী রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন অংশীদার বানানো, বিভিন্ন সংস্থাকে মানুষের কাছে নিয়ে আসার জন্য জাতিসংঘের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন তিনি। কফি ছিলেন খোদ জাতিসংঘ এবং জাতিংসংঘ মানে কফি আনান।

তিনি আরও ছিলেন আমার সেরা বন্ধু। জীবনজুড়ে বিভিন্ন পথে একসঙ্গে চলেছি আমরা। যখন পূর্ব তিমুরের মানুষ স্বাধিকার চাইলেন, আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। তিনি জাতিসংঘ থেকে আর আমি পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেখানকার মানুষের ভোগান্তির শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথকে সমর্থন করেছি।

যখন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়েছিল, কফি তার আস্থার সঙ্গে আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন, প্রস্তাব করেছেন ভূমিকাটি নিতে পারি কি না। তারপর অরক্ষিত মানুষের বেশির ভাগকে রক্ষা ও আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে অবিচল সমর্থন দিয়ে গেছেন।

একসময় কফি যে অফিসের কর্তৃত্ব করতেন, এখন সেটি আমি করি। আমি সবসময় অবিচ্ছিন্নভাবে তার সততা, সক্রিয়তা ও উৎসর্গতায় অনুপ্রাণিত হই। তার কাছে উদাসীনতা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে বিষ।

এমনকি সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নিজের মেয়াদ শেষ করার পরও কূটনীতির সামনের সারি থেকে নিজের লড়াই কখনও বন্ধ করেননি তিনি। কোরিয়ায় নির্বাচন-পরবর্তী উত্তেজনা হ্রাসে তিনি সহায়তা করেছেন, সিরিয়ায় বর্বর যুদ্ধের একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পেতে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়েছেন এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার ফিরে পাওয়া ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পথ তিনি উন্মোচন করেছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন অংশে- উত্তরে, দক্ষিণে, পূর্বে ও পশ্চিমে পা ফেলেছেন কফি আনান। কিন্তু নিজের নিশ্চিত আশ্রয়স্থল হিসেবে কেবল পেয়েছেন নিজের শেকড় ও পরিচয়ের আফ্রিকাকেই। বর্ণবাদবিরোধী মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তাকে ডাকনামে কফি বলে ডাকতেন এবং তাকে বলতেন ‘আমার নেতা’। এটা কোনো মজা বা কৌতুক ছিল না। কফি ছিলেন আমাদেরও নেতা।

যখন সর্বশেষ জাতিসংঘে (খুব বেশিদিন আগে নয়) তাকে আমি দেখেছিলাম, তার হাঁটা ও দাঁড়ানোর এমন ভঙ্গি ছিল যা দিয়ে সবসময় তাকে আমি স্মরণ করব- শান্ত অথচ দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ, হাসতে প্রস্তুত। তিনি এখন আর নেই এবং আমরা তাকে তীব্রভাবে মিস করব। কিন্তু এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত, যদি আমরা নিয়মিতভাবে আগ্রহী হই এবং ভালোভাবে শুনি তবে এখনও আমরা কফির শব্দ এবং তার প্রাজ্ঞ পরামর্শ শুনতে পারি।

‘দয়া করে চালিয়ে যান’ তিনি বলছেন, আমি শুনতে পাচ্ছি। ‘আপনারা জানেন কী করতে হবে : একে অপরের যত্ন নিন। আমাদের গ্রহটির যত্ন নিন। সব মানুষের মধ্যে মানবতার স্বীকৃতি দিন। আর সমর্থন করুন জাতিসংঘকে- যা এমন স্থান যেখানে সমস্যাগুলোর সমাধান এবং সবার জন্য আরও ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে আমরা সবাই একত্রিত হতে পারি।’

চলুন, নিয়মিতভাবে আমরা দয়া ও যৌক্তির এ কণ্ঠস্বরের প্রতি, নৈতিকতা ও সংহতির এ কণ্ঠস্বরের প্রতি মনোযোগী হই। আমাদের বিশ্বের জন্য এটি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি দরকার।

যেহেতু আমরা আমাদের সমস্যাগ্রস্ত এবং অসংযত সময়ের বিপরীতমুখী বাতাসের মুখে পড়েছি, আসুন, সবসময় কফি আনানের উত্তরাধিকার থেকে আমরা অনুপ্রাণিত হই এবং যে জ্ঞানের কথা তিনি সবসময় আমাদের বলতেন, আমাদের তাড়া দিতেন, ওইসব লক্ষ্যমাত্রার দিকে যার জন্য নিজের জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন এবং সত্যিকারার্থে পৃথিবীকে চালিত করেছেন- আসুন সেগুলো মোতাবেক পথ প্রদর্শিত হই।

অ্যান্তোনিও গুতেরেস: জাতিসংঘের মহাসচিব, ঘানার আক্রায় ১৩ সেপ্টেম্বর কফি আনানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় দেয়া তার ভাষণের ওপর ভিত্তি করে লেখাটি তৈরি

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version