এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মশাবাহিত মারাত্মক রোগ ডেঙ্গু। রাজধানীর পাশাপাশি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশালেও ব্যাপক হারে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এসব অঞ্চলের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা যুগান্তরকে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে এ সংক্রান্ত ঢাকার বাইরের কোনো তথ্য নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার পরিস্থিতি বিবেচনায় ডিসেম্বর পর্যন্ত এ রোগের প্রাদুর্ভাব থাকতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর শুধু রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত ১৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

আর ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সাত হাজার ৪৫০ জন। সেই হিসেবে রাজধানীতে গড়ে প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২৫০ জন। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৮৯ রোগী। শুধু সোমবার এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫১ জন।

জানা গেছে, রাজধানীর ১৪টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল এবং ৩৫টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের তথ্য হালনাগাদ করা হয়।

ঢাকার বাইরের কোনো তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে নেই। ফলে অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম থেকে এ সংক্রান্ত যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়, প্রকৃতপক্ষে তা অন্তত ১০ গুণ বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. প্রবীর মোহন বসাক যুগান্তরকে জানান, সরকারি হাসপাতালে এবং প্রাইভেট চেম্বারে তারা ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছেন।

কিছু দিন আগেও রোগীর সংখ্যা বেশি ছিল, বর্তমানে কিছুটা কমেছে। তবে রোগী নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

একই ধরনের তথ্য জানান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মুসতাকিম রূপম। তিনি জানান, হাসপাতাল ও প্রাইভেট ক্লিনিকের প্যাথলজি বিভাগে ডেঙ্গুর নমুনা পাওয়া যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্যও একই রকম। এসব হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, অতীতেও বিভিন্ন সময় তারা ডেঙ্গু রোগী পেয়েছেন। তবে এবার রোগীর সংখ্যা বেশি।

সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের একজন ইনফু¬য়েঞ্জা বিশেষজ্ঞ যুগান্তরকে বলেন, এডিস মশা ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস ছড়ায়। ডেঙ্গুতে চার ধরনের ভাইরাস (সেরোটাইপ) রয়েছে- ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। এই চার ধরনের ভাইরাসই বাংলাদেশে আছে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

তিনি আরও বলেন, সাধারণত যেকোনো একটি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর একই ধরনের ভাইরাসে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। কারণ, মানুষের শরীরে ভাইরাসটির প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।

তবে অন্য তিন ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। যেসব রোগী দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। কারণ নতুন ভাইরাসটি শরীরে পাঁচ দিন থাকে।

এ সময় শরীরে থাকা পূর্বের ভাইরাসের অ্যান্টিবডি এবং নতুন ভাইরাসের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। ফলে রক্তক্ষরণের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। যা থেকে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুও ঘটে থাকে। তিনি জানান, দেশের আবহাওয়ার বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুতে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়াটা যেকোনো রোগীর জন্য ভয়বহ। কেননা প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বারের ভয়াবহতা প্রায় ২০০ গুণ বেশি। আক্রান্তের অল্প সময়ের মধ্যে রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে।

অনেক রোগীর পেটে বা বুকে পানি জমে। এছাড়া দ্বিতীয়বারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর হারও বেশি। তারা জানান, একবার যে দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে সে দেশ থেকে ডেঙ্গু চিরতরে বিদায় হয় না। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা যুগান্তরকে বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপের মধ্যে ডেন-৩তে আক্রান্ত হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ।

এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ। তাছাড়া পরীক্ষা করে দেখা গেছে ডেঙ্গু নিয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তারা বেশির ভাগই দ্বিতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছেন।

ডা. সানিয়া আরও বলেন, সারা দেশে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তবে এদের বেশির ভাগই ঢাকায় এসে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই।

তিনি বলেন, থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। অধিদফতরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্থানে কিট দেয়া হচ্ছে। তবে সামাজিক সচেতনতা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version