এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নীল বেদনা নিয়ে চলে গেলেন রুপালি গিটারের ফেরিওয়ালা। দূরে, বহুদূরে। দরজার ওপাশে। তার গানের কথাই যেন সত্য হলো-এই রুপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাবো দূরে, বহু দূরে। কে জানতো সেই একদিন এত দ্রুত চলে আসবে। হঠাৎ করেই তার এই চলে যাওয়া। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় মগবাজারের নিজ বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়েন গিটার লিজেন্ড, কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী, ব্যান্ড সংগীতের বটবৃক্ষ আইয়ুব বাচ্চু। এরপর দ্রুত রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)।

চিকিৎসকরা তাকে সকাল ১০টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। আজ জাতীয় ঈদগাহে বাদ জুমা প্রথম জানাজা শেষে তার লাশ নিয়ে যাওয়া হবে চট্টগ্রামে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে আগামীকাল পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে তাকে।

কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পীর মৃত্যুতে সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেছেন আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুতে। শোক জানিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আরো অনেকে। তার মৃত্যুর পরপরই সংগীতসহ বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষেরা ভিড় করেন হাসপাতালে। উপস্থাপক হানিফ সংকেত, কণ্ঠশিল্পী রফিকুল আলম, কুমার বিশ্বজিৎ, কৌশিক হোসেন তাপস, সামিনা চৌধুরী, বাপ্পা মজুমদার, অভিনেতা শঙ্কর সাঁওজাল, আর্টসেল ব্যান্ডের লিংকন, অভিনেত্রী বন্যা মির্জা, নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফসহ হাজার মানুষের ঢল নামে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। ভক্তদের কান্নায় এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ তৈরি হয়ে সেখানে। তাদের মাতম থামানোর যেন কোনো উপায় ছিল না। ১৬ই অক্টোবর রাতে রংপুরে একটি কনসার্ট শেষ করে ১৭ই অক্টোবর দুপুরে ঢাকায় ফেরেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৮ই অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাসায় হার্ট অ্যাটাক করেন তিনি। তড়িঘড়ি করে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে ২০১২ সালের ২৭শে নভেম্বর ফুসফুসে পানি জমার কারণে স্কয়ার হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়ে আবারো গানে ফেরেন। কিন্তু এবার আর ফেরা হলো না এ সংগীত তারকার।

দেশের শীর্ষ ব্যান্ড এলআরবি’র দলনেতা আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গায়ক, গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। গিটারের জাদুকর হিসেবে সারা বিশ্বে সুনাম ছিল তার। ভক্তদের কাছে তিনি ‘এবি’ নামেও পরিচিত। ১৯৬২ সালের ১৬ই আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৭৮ সালে ফিলিংস ব্যান্ডের মাধ্যমে সংগীত জগতে তার পথচলা শুরু হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সোলস ব্যান্ডে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে এলআরবি গঠন করেন আইয়ুব বাচ্চু। ব্যান্ডটির স্বনামে অ্যালবাম বাজারে আসে ১৯৯২ সালে। এটাই দেশের প্রথম ডাবল অ্যালবাম। এলআরবি’র অন্য অ্যালবামগুলো হলো ‘সুখ’ (১৯৯৩), ‘তবুও’ (১৯৯৪), ‘ঘুমন্ত শহরে’ (১৯৯৫), ‘ফেরারী মন’ (১৯৯৬), ‘আমাদের’ (১৯৯৮), ‘বিস্ময়’ (১৯৯৮), ‘মন চাইলে মন পাবে’ (২০০১), ‘অচেনা জীবন’ (২০০৩), ‘মনে আছে নাকি নাই’ (২০০৫), ‘স্পর্শ’ (২০০৮), ‘যুদ্ধ’ (২০১২), ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ (২০১৬)। ব্যান্ডের পাশাপাশি একক ক্যারিয়ারেও তুমুল সফল ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘রক্তগোলাপ’ তার প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। তার সাফল্যের শুরুটা হয় দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’র (১৯৮৮) মাধ্যমে। ১৯৯৫ সালে বাজারে আসে তার তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এ অ্যালবামের ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ‘আমিও মানুষ’ গানগুলো ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। তার অন্য একক অ্যালবামগুলো হলো ‘সময়’ (১৯৯৮), ‘একা’ (১৯৯৯), ‘প্রেম তুমি কি’ (২০০২), ‘দুটি মন’ (২০০২), ‘কাফেলা’ (২০০২), ‘রিমঝিম বৃষ্টি’ (২০০৮), ‘বলিনি কখনো’ (২০০৯), ‘জীবনের গল্প’ (২০১৫)। আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘চলো বদলে যাই’, ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘হকার’, ‘সুখ’, ‘রুপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’, ‘তারা ভরা রাতে’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘সেদিন কথা রাখোনি’সহ অনেক গান। রক ঘরানার গানের এই শিল্পী আধুনিক আর লোকগীতিতেও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। বেশকিছু চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া প্রথম গান ‘লুটতরাজ’ ছবির ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এ ছাড়া ‘আম্মাজান’ ছবির শিরোনাম গানটিও জনপ্রিয়।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version