এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জাতীয় নির্বাচনের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে এমপি, এমপি প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলের নেতাদের না রাখার চিন্তা চলছে। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) এ পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা’ সংশোধনের প্রস্তাব করেছে ইসির আইন সংস্কার কমিটি। আগামীকাল রোববার অনুষ্ঠেয় কমিশন সভায় এ প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য তোলা হচ্ছে।

এতে আচরণ বিধিমালায় রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী সভার অনুমতি সংক্রান্ত বিষয়সহ মোট চারটি ধারা সংশোধনীর প্রস্তাবও থাকছে। তবে তফসিলের পর সরকারি প্রটোকল তুলে নেয়াসহ এমপিদের অন্যান্য সুযোগ সুবিধা কমিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো প্রস্তাব করেনি এ কমিটি। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধানের ওপর থাকতে চায় কমিশন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কমিশন সভায় এ প্রস্তাবটি অনুমোদন হলে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে বর্তমান এমপি আছেনম তিনি যদি এবারও একই পদে নির্বাচন করেন তবে তাকে পর্ষদ থেকে সরে যেতে হবে। এ ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতারা সভাপতি ও সদস্য পদে আছেন তারাও কেউ পদে থাকতে পারবেন না।

ইসির আইন সংস্কার কমিটি মনে করছে, এতে শিক্ষক-কর্মচারীদের ওপর প্রভাব কমবে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে শিক্ষকদের নিরপেক্ষভাবে কাজের পথ সুগম হবে। ভোটগ্রহণে যেসব প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার থাকেন তাদের বেশির ভাগই শিক্ষক। পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বা সদস্যের হাতে শিক্ষকদের চাকরি সংক্রান্ত বেশ কিছু বিষয় সংরক্ষিত আছে। এতে শিক্ষকরা এক ধরনের মানসিক চাপে থাকেন।

আচরণ বিধিমালা সংশোধন প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, কমিশন সভায় আইন সংস্কার কমিটি আচরণ বিধিমালা সংশোধনীর প্রস্তাব পেশ করবেন। প্রস্তাবে কী আছে তা এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না। সাধারণত বিভিন্ন সংশোধনের প্রস্তাব কমিটি উত্থাপন করা হয়ে থাকে। সেগুলো দেখে কমিশনাররা মতামত দিয়ে থাকেন।

নির্বাচনের সময় এমপিদের প্রভাব বিস্তার রোধের বিষয়ে ইসি কিছু ভাবছে কী না- এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, এমপি, মন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রচারের সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো বর্তমান আচরণ বিধিমালায় বিদ্যমান।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল আগামী নভেম্বর মাসে ঘোষণার চিন্তাভাবনা আছে ইসির। সে অনুযায়ী ডিসেম্বরে ভোটগ্রহণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ওই নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবেই আচরণবিধি সংশোধনসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম চলছে।

জানা গেছে, সারা দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিগ্রি-অনার্স মাস্টার্স বা সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে সংসদ সদস্যরা সভাপতি হিসেবে আছেন। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও সভাপতিসহ বিভিন্ন পদে আছেন।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধিমালা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ অসীম ক্ষমতার অধিকারী। নিয়োগ, বরখাস্ত, চাকরিচ্যুতি, পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট দেয়াসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা পর্ষদের হাতে ন্যস্ত। শিক্ষক বা কর্মচারীদের কেউ কোনো অপরাধ করলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সরাসরি অ্যাকশন নিতে পারে না। এজন্য সরকার বা মন্ত্রণালয়কেও পরিচালনা পর্ষদের কাছে ধরনা দিতে হয়।

ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার কমিশনের ৩৭তম সভা ডাকা হয়েছে। এ সভায় তিনটি এজেন্ডা রাখা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০০৮’ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী (প্রার্থিতার পক্ষে সমর্থন যাচাই) বিধিমালা সংশোধন এবং বিদেশি পর্যবেক্ষকদের জন্য নীতিমালা। সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালায় মোট চারটি সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে।

এর মধ্যে বিদ্যমান বিধিমালার ৬(১)(খ) ও ১৪(৪) ধারায় সংশোধনী এবং ৭(৫ক) ও ৯ক ধারা সংযোজনের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ৭(৫ক) ও ৯ক উপধারা দুটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আচরণ বিধিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকালে ওই সভার কার্যপত্র সিইসি ও অন্য কমিশনারদের দেয়া হয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ থেকে এমপি, এমপি প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের না রাখার বিষয়ে আচরণবিধির ১৪(৪) ধারায় সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধনীতে উল্লেখ করা হয়েছে ‘কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কমিটির কোনো সদস্য/নেতা/কর্মী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে পূর্বে সভাপতি বা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত বা মনোনীত হইয়া থাকিলে বা তদকর্তৃক কোনো মনোনয়ন প্রদত্ত হইয়া থাকিলে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে তিনি বা তদকর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে থাকিতে পারবেন না।’

এ সংশোধনীর যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সভাপতি বা সদস্য হিসেবে বহাল থাকলে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা আছে। সেটা রোধে এ সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০০৯ সালের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির প্রবিধানমালা অনুযায়ী, একজন এমপি উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের চারটি পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি হতে পারেন। এ ছাড়া এলাকার অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপির মনোনয়নে (তার) পছন্দের ব্যক্তিরা সভাপতি হয়ে থাকেন। আর অভিভাবক প্রতিনিধি, শিক্ষানুরাগী/বিদ্যানুরাগী, শিক্ষক প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মূলত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাই সদস্য পদে আসীন হয়ে থাকেন।

অন্য তিন প্রস্তাবে যা আছে : আচরণ বিধির অন্য তিন প্রস্তাব হচ্ছে- নির্বাচনী সভার বিষয়ে পুলিশের অনুমতি সংক্রান্ত, প্রচারে ডিজিটাল ডিসপ্লে ব্যবহার না করা ও প্রতীক হিসেবে জীবন্ত প্রাণীর ব্যবহার বন্ধ করা। জানা গেছে, বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সভা করতে হলে পুলিশের অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে পুলিশের অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ওই বাধ্যবাধকতায় কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।

আচরণ বিধিমালার ৬(১)(খ) ধারা প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, সভা করার আগে দিন, সময় ও স্থান সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি দেয়ার পদ্ধতি নিয়ে দুটি উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ৬(১)(খ)(অ) এ বলা হয়েছে পুলিশ আবেদনপ্রাপ্তির সময়ের ক্রমানুসারে অনুমতি প্রদান করতে হবে। (আ) লিখিত আবেদনপ্রাপ্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হবে, তবে উক্ত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত দেয়া না হলে ওই সময়ের পর আবেদনে উল্লেখিত অনুমতি প্রদান করা হয়েছে মর্মে গণ্য হবে।

ইসির কর্মকর্তারা জানান, এ বিধান সংযোজন হলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী সভা করার অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে যে হয়রানির শিকার হতে হয়, তা দূর হবে।

অন্য সংশোধনীর মধ্যে বিধি ৭ এর উপবিধি ৫ এর পর (৫ক) নতুন বিধি সংযোজন করে বলা হয়েছে- নির্বাচনী প্রচারে কোনো প্রকার ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ড ব্যবহার করা যাবে না। বিধি ৯ এর পর উপবিধি ৯৫ যুক্তের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে প্রতীক হিসেবে জীবন্ত প্রাণী ব্যবহার করা যাবে না। ইসির কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আচরণ বিধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ দুটি উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

আচরণ বিধি সংশোধন প্রসঙ্গে বুধবার ইসির আইন সংস্কার কমিটির আহবায়ক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, আচরণ বিধিতে কিছু বিষয়ে সংশোধনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচনের প্রচারে জীবন্ত প্রাণী ব্যবহার না করা, ডিজিটাল ডিসপ্লে ব্যবহার না করার বিষয় আছে। সোস্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মতো কিছু নেই।

এমপিদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে বিদ্যমান বিধিতেই থাকতে চায় ইসি : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপিদের প্রচারের বিষয়ে বিদ্যমান বিধি-বিধানের ওপর থাকতে চায় নির্বাচন কমিশন। এ কারণে এমপিদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আচরণ বিধিমালায় সংশোধনের প্রস্তাব করেনি আইন সংস্কার কমিটি।

বিদ্যমান আচরণ বিধিমালার ৩, ৪, ৫ ও ১৪ ধারায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার না করার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। তবে এসব বিধানই যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান আচরণ বিধিমালা যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমপিদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে। যেমন- আইনি কাঠামোতে একজন এমপি উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা। তাকে কোন আইনবলে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম থেকে বিরত রাখবেন? সবমিলিয়ে এমপিদের বিষয়ে বিস্তারিত বিধি-বিধান আচরণ বিধিমালায় যুক্ত করা যেতে পারে।

ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) সংশোধন এখনও ঝুলে আছে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা সংশোধনের বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় নির্বাচনের ম্যানুয়েল ছাপানো যাচ্ছে না। তফসিল ঘোষণার আগেই এসব ম্যানুয়েল ছাপতে হবে। ম্যানুয়েল না পেলে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা নির্বাচনের কার্যক্রম ভালোভাবে শুরু করতে পারবেন না। ইসির রোডম্যাপে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে আইন সংস্কার না হওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন ইসির কর্মকর্তারা।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version