এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : গণপরিবহন চলাচল বন্ধ। সিএনজি অটোরিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলেও শ্রমিকদের বাধা। জরুরি প্রয়োজনে গাড়ি নিয়ে যারাই রাস্তায় নেমেছে মারমুখী শ্রমিকদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। হয় গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে না হয় চালকের মুখে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে পোড়া মবিল। পরিবহন শ্রমিকদের নগ্ন হেনস্তা থেকে বাদ যায়নি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও। রোগীবহনকারী অ্যাম্বুলেন্সে মবিল মাখিয়েছে তারা। গতকাল সকাল থেকে দিনভর সারা দেশে ছিল অরাজক অবস্থা। সড়ক পরিবহন আইন বাতিলের দাবিতে পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে সকাল থেকে শুরু হয় ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট।
শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে ধর্মঘট হলেও ব্যক্তিগত গাড়ি, রপ্তানিসহ বিভিন্ন জরুরি সেবার যানবাহন আটকে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে পথে পথে। ধর্মঘটে অচল ছিল পুরো দেশ। লাখ লাখ মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের নামে এই ধর্মঘট ডাকে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। মন্ত্রী এ সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি। পুরো দেশকে জিম্মি করে ধর্মঘট ডাকার বিষয়ে কোনো কথা বলেননি শাজাহান খান। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে রাতে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। যদিও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন এই মুহূর্তে আইন পরিবর্তন সম্ভব নয়।
৮ দফা দাবিতে ধর্মঘট চলাকালে সকাল থেকে সরকারি মালিকানাধীন বিআরটিসি’র কিছু সংখ্যক বাস ছাড়া কোনো গণপরিবহন রাস্তায় দেখা যায়নি। তবে বিভিন্ন রুটে ব্যক্তিগত গাড়ি, ভাড়ায় চালিত সিএনজি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করতে দেখা গেলেও চালকরা দাবি করেন পথে পথে পরিবহন শ্রমিকরা তাদের হেনস্তা করেন। সকালে মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে, নাবিস্কো থেকে মহাখালী মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বাসের সারি। পার্ক করে রাখা হয়েছে এসব গণপরিবহন। রাস্তায়, চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন শ্রমিকরা। যাত্রীরা আসছেন, হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। তাদেরই একজন বিলকিস বেগম। দ্বিগুণ টাকায় সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ থেকে মহাখালী পৌঁছেন। সঙ্গে দুই শিশু সন্তান।
উদ্দেশ্য গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বীরগঞ্জে যাবেন। শাশুড়ি অসুস্থ। এতটা পথ গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। বিলকিস বলেন, ‘গরিব মানুষ। বিপদে পড়ে গেছি। এখন কেমনে কি করি। গাড়ি তো ছাড়বে না।’ কথা বলছিলেন আর অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন তিনি। তারপর সিএনজি অটোরিকশাতে করেই ফিরে যান তিনি। রিকশা থেকে নেমে দ্রুত এনা পরিবহনের কাউন্টারে ছুটে যান শরণ। বাসের কাউন্টার বন্ধ। ফোনে কল দিলেও রিসিভ করছে না কেউ। শরণ সোমবারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে চট্টগ্রামে যাবেন। টিকিট কেটে রেখেছিলেন বেশ আগেই।
শনিবার যখন জানতে পারলেন শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকেছে ঠিক তখনই ওই পরিবহন সার্ভিসের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেন। শরণ জানান, কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়েছেন, টিকিট বাতিল করা হয়নি। তাই গাড়ি ছাড়তে পারে। তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়েই গতকাল ফার্মগেট থেকে দুপুরে মহাখালী ছুটে যান তিনি। এখন কি করবেন জানতে চাইলে শরণ বলেন, কি করবো বুঝতে পারছি না। ট্রেনে দাঁড়িয়ে যাওয়া যায় কিনা চেষ্টা করবো। এ ছাড়া উপায় নেই। পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবো কিনা বুঝতে পারছি না। কথা বলার সময় তার চোখ ছলছল করছিলো। ধর্মঘট জানার পরও বাসস্ট্যান্ডে গিয়েছিলেন নিকেতনের লুৎফর রহমান। তিনিসহ বেশ কয়েক জন যাবেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে। সোমবারে তার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে। চাচাতো ভাইয়ের অভিভাবক বলতে লুৎফর রহমান। না গিয়ে উপায় নেই। পরিবহন শ্রমিকদের কাছে বারবার জানতে চাচ্ছিলেন, গাড়ি কখন ছাড়বে, ধর্মঘট কী আজ শেষ হবে না? লুৎফরসহ বিভিন্ন যাত্রীদের এরকম নানা প্রশ্নে বিরক্ত হচ্ছিলেন শ্রমিকরা।
বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা গেছে, শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছেন শ্রমিকরা। কেউ কেউ অলস সময় কাটাচ্ছিলেন চায়ের দোকানে। বাসস্ট্যান্ডে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে ভিড় করেন তারা। শ্রমিকরা বলেন, আমরা শ্রমিক। জরিমানা দেব, জেল খাটবো। এটা হবে না। এসব আইন মানি না। শ্রমিকদের মধ্যে ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটের ইমাম পরিবহনের সুপারভাইজার শামীম শেখ বলেন, দেশের মানুষ কী সব শিক্ষিত হয়ে গেছে, যে অষ্টম শ্রেণি পাস ছাড়া গাড়ি চালানো যাবে না। আমরা গরিব মানুষ। লেখাপড়া করতে পারিনি। ভাতা জুটে না ঠিকমতো, লেখাপড়া করবো কীভাবে? এখন যদি গাড়ি চালাতে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হয় তাহলে না খেয়ে মরতে হবে আমাদের। পাঁচ বছরের জেল-জরিমানা থাকলে কেউ গাড়ি চালাবে না।
এই আইন পরিবর্তন করতে হবে বলে দাবি করেন এই শ্রমিক। মহাখালী, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে কোথাও কোনো গণপরিবহন নেই। বৃদ্ধা মাকে ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন এক তরুণী। বাংলামোটর এলাকায় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, তালতলায় দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কোনো গাড়ি পাননি। মা অসুস্থ। তাকে ঢাকা মেডিকেলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর কথা। এতদূরে রিকশায় যাওয়া সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়েই ভ্যানে উঠেন। তবে অনেককেই দেখা গেছে, পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে। রাজধানীর রাস্তাগুলো ছিল ফাঁকা। প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ও রিকশা-অটোরিকশা ছাড়া কোনো গণপরিবহনের দেখা মিলেনি।
সকাল থেকেই যাত্রাবাড়ী মোড়ে অবস্থান নেন ওই এলাকার পরিবহন শ্রমিকরা।
সেখান থেকে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে তারা ডেমরা, পোস্তগোলা, দয়াগঞ্জ, চিটাগাং রোডে অবস্থান নেন। এসময় তারা ওইসব সড়কে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কার, ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেলের ওপর হামলা করেন। পোড়া মবিল লাগিয়ে দেন গাড়ি ও চালকের শরীরে। এ ছাড়া নানাভাবে করেন হেনস্তাও। কেউ কেউ গাড়িতে লাথি-ঘুষি দিয়ে ভেঙে দেন প্রাইভেট গাড়ির হেডলাইটসহ নানা যন্ত্রাংশ। শ্রমিকদের হাতে-পায়ে ধরেও রেহাই পাননি অনেকে। সারা দিনই বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ধর্মঘট পালন করেন শ্রমিকরা। দুপুরের দিকে যাত্রাবাড়ী থানা থেকে ১০০ গজ দূরে চিটাগাং রোডে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমিকরা একের পর এক প্রাইভেট গাড়ির যাত্রী ও চালকদের হেনস্তা করছিলেন।
খিলগাঁও থেকে আসা ঢাকা মেট্রো থ-১৩-১৯৪০ নম্বরের একটি সিএনজিকে আটকে তারা ভাঙচুর করেন। লাথি দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে দেন সিএনজিটিকে। এসময় শ্রমিকরা ওই চালকের পুরো শরীর মবিল দিয়ে লেপ্টে দেন। তার কিছুক্ষণ পর ঢাকা মেট্রো গ-১৭-৭৩৭৩ নম্বরের একটি প্রাইভেট কারকে একইভাবে হেনস্তা করতে দেখা গেছে। বিকালের দিকে ডেমরা সড়কে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বহন করা একটি বাসের চালকের ওপর পোড়া মবিল ঢেলে দেয় শ্রমিকরা। এসময় শিক্ষার্থীরা শ্রমিকদের ওপর ক্ষেপে উঠেন। বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা সড়কে অবস্থানরত শ্রমিকদের ধাওয়া করেন। ধাওয়া খেয়ে শ্রমিকরা সেখান থেকে পালিয়ে যান। শ্রমিকরা পালিয়ে গেলেও শিক্ষার্থীরা সড়কে আড়াআড়ি বাস দাঁড় করিয়ে বিক্ষোভ করেন। পরে সেখানে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এ ছাড়া পরিবহন ধর্মঘট থাকার কারণে সড়কে কোনো ধরনের বাস চলাচল না থাকায় সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি ছিল চরমে। যাত্রাবাড়ী মোড়ে হাজার হাজার যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। অনেকে জরুরি প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে যেতে চাইলেও কোনো পরিবহনের দেখা পাননি। বিকল্প হিসেবে রিকশা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়েছে। জরুরি কাজে মিরপুর যাওয়ার জন্য যাত্রাবাড়ী মোড়ে দাঁড়িয়েছিলেন আশরাফি সুলতানা। তিনি বলেন, এ কেমন ভোগান্তি শুরু হয়েছে। দীর্ঘক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি তবুও একটাও বাসের দেখা পেলাম না। এখন এতদূর রিকশা নিয়ে যাওয়ার উপায় নাই। আবার না গেলেও হবে না। অনেক সিএনজিকে সিগন্যাল দিয়েছি। তারা মিরপুর যেতে অনেক ভাড়া চায়। অসুস্থ রোগী দেখতে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে কোনো বাস পাননি যাত্রাবাড়ীর সোহেল হায়দার। পরে ৪০০ টাকা খরচ করে তিনি বিশ্বরোড পর্যন্ত একটি সিএনজি ভাড়া করেন। নারায়ণগঞ্জ যাবার জন্য বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মানিকনগরের আয়েশা খাতুন ও তার ছোট দুই সন্তান। মানিকনগর থেকে রিকশা করে এসে পৌঁছান যাত্রাবাড়ী। সেখানে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। রিকশা করেও এতদূর যাওয়া সম্ভব নয়। পরে তিনি বাধ্য হয়েই ফিরে যান বাসায়।
এদিকে গতকাল সকাল থেকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে কোনো দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যেতে দেখা যায়নি। টার্মিনাল ও তার আশেপাশের সকল সড়কে সারিবদ্ধভাবে বাস পার্কিং করে রাখা হয়েছিলো। শ্রমিকরা তখন বিভিন্ন সড়কে দলবেঁধে ধর্মঘট পালন করছিলেন। আর বাস টার্মিনালের বাসের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় শত শত যাত্রীকে। শাহ আলম নামের এক যাত্রী বলেন, প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে সপরিবারে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। জরুরি কাজে পরিবার নিয়ে সিলেট যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এখানে একটি বাসের কাউন্টারও খোলা নাই। কি করে সিলেট যাবো জানি না। ভৈরবগামী আরেক যাত্রী সোহেল মিয়া জানান, কয়েক ঘণ্টা ধরেই এখানে দাঁড়িয়ে আছি। কোনো বাস ছাড়ছে না। শুনেছি সকাল থেকে একটাও বাস ছেড়ে যায়নি।
একই চিত্র দেখা গেছে, রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে। দিনভর সেখান থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। আশেপাশের এলাকায় অবস্থান নিয়ে পরিবহন শ্রমিকরা কোনো যানবাহন চলতে দেয়নি। ওই এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা ও লেগুনা চলাচলেও বাধা দেয় শ্রমিকরা।