ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.) : আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচন ৬ নভেম্বর ২০১৮; এদিন প্রতিনিধি সভার ৪৩৫ সদস্য, সিনেটের ৩৩ সদস্য ও ৩৬ রাজ্য গভর্নরের নির্বাচন। এছাড়া আরও কয়েকটি নির্বাচন আছে যা খুব প্রাসঙ্গিক, যদিও তা প্রথাগত নির্বাচন নয়। এসব নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্প দারুণ উৎসাহী। একেক রাজ্যে যাচ্ছেন; নিজ ভঙ্গিতে বক্তৃতা করছেন। সাধারণ মানুষের জন্য তার নীতি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ভালোই কাজ করছে। সংবাদকর্মীরা যতই তাকে নিয়ে ঠাট্টা করুক, বিদ্রূপ করুক- তিনি নির্বিকার। অবশ্য সংবাদকর্মীদেরও তিনি ছেড়ে কথা বলেন না। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, তুরস্ক, চীন, রাশিয়া- এমনকি প্রতিবেশী কানাডাকেও তিনি ছেড়ে কথা বলেন না; সবাইকে মনে করিয়ে দেন আমেরিকার স্বার্থই বড়।

আমেরিকার উদার মনোভাব, বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা তার কাছে ‘অযথা খরচ’। তিনি তার পূর্বসূরিদের এসব খরচ ও সাহায্যে রীতিমতো অসন্তুষ্ট। তাই দূরে সরে আসছেন পূর্বের অনেক চুক্তি থেকে। অন্যদিকে আমেরিকার অর্থনীতি ভালোর দিকে। আমেরিকায় বেকার সমস্যা কমে আসছে। সবচেয়ে ভালো করছে আমেরিকার ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি, প্রতিরক্ষা কারখানাগুলো। সস্তা তেলে চলছে আমেরিকার কারখানাগুলো। আর উৎপাদিত মারণাস্ত্র কিনছে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো চড়া দামে।

রাশিয়ার হস্তক্ষেপ : জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার ডিরেক্টর ডেন কোটস বলেছেন- জাতীয় নির্বাচনে রাশিয়া আমেরিকাকে আঘাত হানতে প্রস্তুত ও সক্ষম। এ বছরই আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ৬টি নিরাপত্তা এজেন্সি একই মত পোষণ করে বলে- আমেরিকার নির্বাচনে হস্তক্ষেপের জন্য রাশিয়া রীতিমতো তৈরি হয়ে আছে। রাশিয়ার এজেন্টরা এজন্য আমেরিকান নির্বাচন পদ্ধতি ও প্রস্তুতিগুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে। আমেরিকান এজেন্সিগুলো একমত যে, রাশিয়ার সাইবার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ও তা অনুপ্রবেশের পূর্বেই ধ্বংস করতে আমেরিকা অপারগ। যেমন মিসৌরির ডেমোক্রেট সিনেটর ক্লেয়ার ২৬ জুলাই অভিযোগ করেন- রাশিয়ার গুপ্তচররা তার সিনেট ই-মেইল অ্যাকাউন্টে ঢোকার জন্য আক্রমণ চালায়। আগস্ট মাসে এফবিআই ডিরেক্টর ক্রিস্টেফার হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে বলেন- ২০১৮ সালের মধ্যবর্র্তী নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ঘটনাগুলো সত্য এবং তা চলমান। ৮ আগস্ট ফ্লোরিডার সিনেটর বিল নেলসন বলেন- ফ্লোরিডার নির্বাচন পদ্ধতিগুলোর ভেতরে ঢুকে গেছে রাশিয়ার হ্যাকাররা। এক্ষেত্রে ভোটারদের ভোট প্রদানে অসুবিধা সৃষ্টি, ভোটার লিস্ট থেকে নাম বাদ ও পরিবর্তন করে দেয়া ইত্যাদি আক্রমণের টার্গেট হতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য তাদের নির্বাচনে রাশিয়ার এমন হস্তক্ষেপ কাম্য নয় বলেছেন এবং এতে তিনি খুবই শঙ্কিত বলেও উল্লেখ করেছেন।

চীনের হস্তক্ষেপ : ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এক ভাষণে ট্রাম্প অভিযোগ করেন- চীন আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করছে। চীনের রফতানি পণ্যের ওপর আমেরিকার বিলিয়ন ডলার শুল্ক আরোপে চীন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে ট্রাম্প নিজ দেশে ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হন। ট্রাম্প আরও বলেন, তিনিই আমেরিকার একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি চীনের একচ্ছত্র বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। দৃঢ়প্রত্যয়ে তিনি বলেছেন- চীন কখনও অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না। তিনি ট্রাম্পের এ রকম অনাকাক্সিক্ষত দোষারোপ সর্বতোভাবে কাল্পনিক ও অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের ডিরেক্টর ডেন কোটস চীনের সাইবার আক্রমণের পরিধি ও ক্ষমতা অসম্ভব রকম বড় ও কঠিন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন- আমেরিকার বিরুদ্ধে সাইবার আক্রমণে চীন অত্যন্ত ক্রিয়াশীল। আমেরিকার কৃষক, খামারি এবং শিল্প শ্রমিকদের চীন ক্ষেপিয়ে তুলছে। ট্রাম্পের নীতিতে তাদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার শোধ নিতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে চীন।

যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক সম্পর্ক : সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একজন পাদ্রীকে অন্তরীণ করেছিল তুরস্ক, ২০১৬ সালে তুরস্কের সেনা বিদ্রোহে উসকানি দেয়ার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র এজন্য তুরস্কের বিরুদ্ধে বাণিজ্য বিষয়ে বিভিন্ন আক্রমণাত্মক ব্যবস্থা নেয়। ফলে তুরস্কের লিরার দরপতন হয় ৩০ শতাংশের মতো। এ প্রেক্ষাপটে তুরস্ক রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। সিরিয়া সংকটে মোটামুটি মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন ইদলিব অঞ্চলের অবনতিশীল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে আমেরিকার ধর্মযাজককে তুরস্কের আদালত মুক্তি দেয় এবং তিনি তুরস্ক ত্যাগ করেন। এতে বরফ গলতে শুরু করে। এরই মধ্যে ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি তুরস্কের সংবাদপত্রের কল্যাণে প্রকাশিত হয়। সংবাদমাধ্যমের খবরটি তুরস্ক তার নিরাপত্তা এজেন্সি দিয়ে তল্লাশি করে মোটামুটি জেনে ফেলেছে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে সৌদি হিট স্কোয়াড হত্যা করেছে। জামাল খাসোগি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও সৌদি বর্তমান প্রিন্সের কট্টর সমালোচক ছিলেন।

সৌদি আরব ও আমেরিকার সম্পর্ক প্রচুর অর্থের, শতশত বিলিয়ন ডলারের। আমেরিকার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম বিক্রয়ের বড় দেশ সৌদি আরব। আমেরিকার অর্থনীতি, বেকার সমস্যা ইত্যাদি এসব বিষয়ের ওপর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেজন্য আমেরিকা তার বিদেশমন্ত্রী জর্জ পম্পিকে পাঠিয়েছেন তুরস্ক-সৌদি আরব দুই দেশকে ঠাণ্ডা রাখতে। আলোচনা ও তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটনে সচেষ্ট হতে। পর্যবেক্ষকদের মতে, ঘটনা যাই ঘটুক, আমেরিকার দরকার অর্থ, বাণিজ্য ও তেল। আর সেজন্য প্রয়োজন সৌদি সরকারকে। আমেরিকার ভোটারদের কাছে দেশটির বেকার সমস্যার সমাধান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নই বেশি চাওয়ার; যা মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রতিফলনের প্রবল ঝুঁকি আছে। আমেরিকার জনগণ বা ভোটাররা যতই সৌদি আরবের মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের কথা বলুক, তাদের তেল দরকার, রফতানি বাণিজ্যের প্রসার দরকার এবং এসবের কাছে সৌদি মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ ম্লান হতে বাধ্য।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাওয়া হচ্ছে, মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভালো করা। নিজের ভবিষ্যৎ নির্বাচন ছাড়াও বিতর্কিত বিলগুলো পাসের জন্য কংগ্রেসে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা দরকার। সংখ্যাগরিষ্ঠতা জনমত জরিপে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে তার দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচন নিশ্চিত হবে। এজন্য সৌদি আরবে মানবাধিকার সমর্থন বনাম নিজ দেশের বাণিজ্য-সমৃদ্ধি কোনটি বেছে নেবেন, তা তার মিলিয়ন ডলার সিদ্ধান্ত। এছাড়া ট্রাম্প গদি ছাড়া (ইমপিচ) হওয়ার আশঙ্কায় বেশ কিছুকাল ভুগছেন। এটা তার বড় মাথাব্যথা।

আমেরিকার নির্বাচনে প্রেসিডেন্টদের ভদ্রতা ও শুভ রীতিনীতি মেনে চলার একটা প্রয়াস সব পার্টির সব টার্মেই বিদ্যমান ছিল। সরকারি কাজে কোথাও ভ্রমণ করলে পার্টির প্রচারণা না করা সেগুলোর একটি। এসব নর্ম বা রীতি ট্রাম্প মেনে চলছেন না। এতে লাভ বা ক্ষতি কোনটি বেশি হচ্ছে, তা ক্ষমতাসীন অবস্থায় কেউ খুব একটা পাত্তা দেন না। তবে ফল নির্ধারণের পর এসব তথ্য নিয়ে সংবাদকর্মীরা বিশ্লেষণ করেন, লিখেন। তবে তখন আর সময় থাকে না শোধরানোর; এটি শুধু শিক্ষণীয় হয়েই রয়ে যায়। সব দেশের সব পার্টির উদ্দেশেই বোধহয় বলা যায়- ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়াই হল আমাদের ইতিহাস।

সৌদি যুবরাজ সালমান সৌদি আরবে যে সংস্কার শুরু করেছিলেন, খাসোগি হত্যার ঘটনায় তাতে একটু হলেও ছেদ পড়ল। সাংবাদিক হত্যায় যুবরাজের তথা সৌদি আরব দারুণ ইমেজ সংকটে পড়েছে। যুবরাজের ইদানিংকার বিনিয়োগ সম্মেলন ইউরোপীয় দেশ ও বিশ্বের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বয়কট করছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, ব্রাসেলসসহ বহু ইউরোপীয় দেশ, আমেরিকা এবং গুগুলসহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সৌদি আরবের বিনিয়োগ সম্মেলন পরিত্যাগ করেছে। আরব বিশ্ব যে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ভিন্নমত শুনতে চায় না- সাংবাদিক খাসোগি হত্যাকাণ্ড তার বড় প্রমাণ। এসব আমেরিকার অন্ধ সমর্থনের ফল কিনা, সময়ই তা বলে দেবে।

এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক হলেও আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ব্যাপক অভিঘাত সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব ঝামেলা ট্রাম্প কতটা সামাল দিতে পারলেন, তা নভেম্বরের নির্বাচনই বলে দেবে। ২০২০ সালের দ্বিতীয় টার্মে তার নির্বাচন রিপাবলিকান পার্টির জন্য একটি শক্ত পরীক্ষা। ট্রাম্প নিজে ফেল করলেও পার্টি হিসেবে রিপাবলিকান কি ফেল করবে? এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যই নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচন এত গুরুত্বপূর্ণ।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম (অব.) : তুরস্কে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সামরিক অ্যাটাশে

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version