এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : পর্যবেক্ষক না পাঠালেও বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে নিবিড়ভাবে নজরদারি করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। পাশাপাশি প্রকৃত (জেনুইন), বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও সবার অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন প্রত্যাশা করে তারা। জার্মানির অনলাইন ডয়েচে ভেলে’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেনসিয়ে তিরিঙ্ক। এ সময় তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দেখতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়েও কথা বলেন তিনি। জানান, এ আইন নিয়ে মিডিয়া সংশ্লিষ্ট, নাগরিক সমাজের গ্রুপগুলো, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। কথা হয়েছে সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে। এমন পরিস্থিতি সরকার কিভাবে মোকাবিলা করে সেদিকে তাকিয়ে আছেন অনেকে।

রেনসিয়ে তিরিঙ্ক বলেন, আমরা বাংলাদেশের চলমান ঘটনাপ্রবাহের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। বিশেষ করে যখন এখানে বহুত্ববাদ ক্রমেই আক্রমণের শিকারে পরিণত হচ্ছে। এখানে ওই সাক্ষাৎারটি প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে ধরা হলো:

প্রশ্ন: বাংলাদেশ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ককে আপনি কীাবে দেখেন?
উত্তর: দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো, দীর্ঘস্থায়ী। আগে এটা ছিল উন্নয়ন সহযোগিতা হিসেবে। কিন্তু এখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বাণিজ্য। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় গন্তব্য হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

রাজনৈতিক দিক থেকেও আমাদের মধ্যে ভালো ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা মানবাধিকার, সুশাসন, উন্নয়ন কর্মসূচি, সরকারি অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করি। আমি সব সময়ই মনে করি, আরো বেশি কিছু করার সুযোগ আছে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপক সমালোচনা করছে অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো। তারা বলেছে, এ আইন দিয়ে মুক্তভাবে কথা বলার ক্ষেত্রে কণ্ঠরোধ হবে। সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করা হবে। এই আইন নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?

উত্তর: আমরা এখানে বাংলাদেশে সবার কথা শুনেছি। যারা এ আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাদের কথা শুনেছি। এর মধ্যে রয়েছে মিডিয়া, নাগরিক সমাজের গ্রুপগুলো, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী। আমরা এ ইস্যুটি তুলে ধরেছি বাংলাদেশ সরকারের আইনমন্ত্রী ও অন্য উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে। এমন কি এ ইস্যুতে আমরা একটি বৈঠক করেছি। তাতে সভাপতিত্ব করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এসব বৈঠকে আইনটি সম্পর্কে আমাদেরকে আপডেট জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এখনও আইনটি সংস্কার করার সুযোগ আছে। তাই এটা ইতিবাচক হবে যদি সরকার বাস্তবেই আইনটি সংস্কার করে। সরকার কীভাবে জন-উদ্বেগ নিরসন করবে- সেটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছি আমরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিগুলোর দিকে আমরা নিবিড় নজর রাখছি। বিশেষ করে, যখন বহুত্ববাদ ক্রমাগত হুমকিতে রয়েছে।
মুক্ত মত ও মুক্ত সংবাদ মাধ্যম একটি সার্বজনীন মূল্যায়নের মানদণ্ড, যা সমুন্নত রাখার জন্য সচেষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সেজন্য শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ কেমনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখছে আমরা তা নজরদারি করছি।

প্রশ্ন: বিরোধী দলগুলো ও নাগরিক সমাজের গ্রুপগুলো অভিযোগ করছে যে, বাংলাদেশ সরকার ভয়াবহভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কথা বলার স্থান সঙ্কুচিত করছে। এ অভিযোগগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?

উত্তর: এখানকার রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করা আমার পক্ষে আসলেই খুব কঠিন। প্রতিটি পক্ষেরই তার নিজস্ব বক্তব্য আছে। আমি আসলে এ দেশে কী ঘটছে তা দেখার ও বোঝার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন নিয়ে সংলাপে বসছে, এটা একটি ইতিবাচক দিক। এমন পটপরিবর্তনকে আমরা স্বাগত জানাই। বাংলাদেশে আসলে তুলনামূলকভাবে আমি একজন নবাগত। এখানে মাত্র এক বছর হলো এসেছি। আমাকে সব সময়ই বলা হয়েছে যে, যখন নির্বাচন আসে বাংলাদেশে, তখনই রাজনৈতিক অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রাস্তায় রাস্তায় বিশাল সব বিক্ষোভ প্রতিবাদ হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত, অবশ্যই আমি বলবো পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।
এই নির্বাচন নিয়ে আমরা আশাবাদী এবং নির্বাচনকে স্বাগত জানাই। এটা ভালো যে, এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিরোধীরা। আমরা আস্থাশীল ও আশাবাদী যে, এই নির্বাচন হবে জেনুইন, বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ ও সবার অংশগ্রহণমূলক।
প্রশ্ন: কিন্তু নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কেন?

উত্তর: না। আমরা পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছি না। কারণ, বিশ্বাসযোগ্য একটি পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানো একটি অত্যন্ত বড় অপারেশন। এর জন্য প্রয়োজন বিপুল সংখ্যক পর্যবেক্ষক, কয়েক মাসের প্রস্তুতি। তাই, বাজেটের দিক থেকে এটা বড় খরচের একটি বিষয়। আর তাতে প্রচুর উদ্যোগ ও প্রস্তুতির বিষয় থাকে। তাই আমরা এবার পর্যবেক্ষক টিম না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর অর্থ এই নয় যে, এই নির্বাচনকে আমরা ফলো করবো না। অবশ্যই আমরা বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির দিকে নিবিড় মনোযোগ রাখবো। তা ছাড়া বাংলাদেশে ভালো মানের স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা আছেন। সম্ভবত তারাই এই নির্বাচন মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে চমৎকারভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
প্রশ্ন: অর্থের বিষয়টি বাদ দিলে আর কী ক্রাইটেরিয়া আছে, যার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক টিম পাঠানোর বিষয় বিবেচনা করে ইউরোপিয় ইউনিয়ন?

উত্তর: এটা অগ্রাধিকারের বিষয়। আমি সবকিছু বিস্তারিত বলতে পারবো না। কারণ, সারা বিশ্বে অসংখ্য নির্বাচন হয়ে থাকে। তাই আমরা অত্যন্ত তথ্যবহুল উপায়ে সিদ্ধান্ত নিই কোথাও পর্যবেক্ষক মিশন পাঠাবো কি না। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রাইটেরিয়ার অন্যতম হলো সময়ের ব্যাপ্তি, যা আমাদের মিশন পরিচালনা করার জন্য পর্যাপ্ত কি না তা বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া সুনির্দিষ্ট কিছু কিছু দেশে নিরাপত্তা নিয়ে টানাপড়েন আছে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বহু সংখ্যক ক্রাইটেরিয়া বিবেচনা করি।

প্রশ্ন: আগামী মাস ও বছরগুলোয় বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র কীভাবে বিবর্তিত হবে বলে আপনি দেখেন?
উত্তর: আমার কাছে কোনো ক্রিস্টাল বল নেই। তাই আমি আগেভাগেই কোনো পূর্বাভাষ দিতে চাই না। আমরা সামনে যেটা দেখতে চাই, তা হলো বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। দেশটিতে বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকুক এমনটাই আমরা প্রত্যাশা করি। বাংলাদেশ আশাতীত ভালো পারফরম করেছে। বিশেষ করে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে। গত পাঁচ দশকে এ দেশের অর্থনৈতিক বিস্তৃতি আকর্ষণীয়। তাই আমরা এ দেশের উন্নয়নকে টেকসই হিসেবে দেখতে চাই। সব বাংলাদেশিকে দেখতে চাই সমৃদ্ধশালী হিসেবে।

সাক্ষাৎকারভিত্তিক ডয়েচে ভেলে’র ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সম্প্রতি বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জেল দ্বিগুণ করেছেন বাংলাদেশের একটি আদালত। তার জেল ৫ বছর থেকে ১০ বছর করা হয়েছে। তার সমর্থকরা বলেন, তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগে এই শাস্তি দেয়া হয়েছে তা সাজানো। শাস্তি এভাবে দ্বিগুণ করায় ওই নির্বাচন নিয়ে আরো সংশয় বেড়েছে।

একদিন আগে অন্য একটি দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের জেল দেয়া হয়েছে। এসব রায়ে প্রধান বিরোধী দল এক বড় বিপদের মুখে পড়েছে। অন্যদিকে আসন্ন নির্বাচনে আবার বিজয় নিশ্চিত করে ক্ষমতা দৃঢ় করতে চাইছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা করছেন সমালোচকরা। তারা সম্প্রতি পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দিকে আঙুল তুলেছেন। এ আইনটির ব্যাপক সমালোচনা করেছে মিডিয়া ও অধিকারবিষয়ক গ্রুপগুলো। বলা হচ্ছে, এ আইনটি ভিন্ন মতাবলম্বী ও মুক্ত মত প্রকাশকে খর্ব করতে ব্যবহার করবে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সরকার বলছে, ভুল তথ্য প্রচার প্রচারণা থেকে দেশকে রক্ষা করতে তারা এ আইন করেছে। আগস্টে হাজার হাজার ছাত্র বিক্ষোভ করার পর সুপরিচিত একজন সাংবাদিক, আইনজীবী ও সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে সরকার।

এর আগে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষিতে বিরোধী কোনো দলের সঙ্গে কোনো রকম সংলাপে বসার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু এখন তারা বিরোধী দলীয় জোট, যার অংশ বিএনপিও, তাদের সঙ্গে সংলাপে বসতে আগ্রহ প্রকাশ করে সরকার। এই সংলাপ বৃহস্পতিবার শুরু হচ্ছে (এরই মধ্যে শুরু হয়েছে)। দক্ষিণ এশিয়ার এই দারিদ্র্যপীড়িত দেশটিতে ভঙ্গুর গণতন্ত্র সত্ত্বেও বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক টিম না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version