ইশান থারুর : ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগির প্রবেশ ও অদৃশ্য হওয়ার প্রায় এক মাস পর বুধবার তুর্কি কর্তৃপক্ষ ভিন্নমতাবলম্বী লেখকের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে বিষয়ে এযাবৎকালের সবচেয়ে শক্তিশালী বিবৃতিটি দিয়েছে।

‘কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশের পরপরই শ্বাসরোধ করে’ খাসোগিকে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছেন ইস্তাম্বুলের প্রধান কৌঁসুলি ইরফান ফিদান। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন কাজটি ছিল সৌদি আরবের একটি দলের ‘পূর্বপরিকল্পিত’।

ফিদান আরও বলেন, ‘শ্বাসরোধে হত্যার পর টুকরো টুকরো করার মাধ্যমে ফের তার শরীর ধ্বংস করা হয় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডটি নিশ্চিহ্ন করার জন্য।’

খাসোগি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সিদ্ধান্তমূলক ঘোষণাটি তুরস্কের পক্ষ থেকে দেয়া হয় সৌদি আরবের কৌঁসুলি সাউদ আল-মোজেব ইস্তাম্বুল ত্যাগ করার পর, যাকে পাঠানো হয়েছিল খাসোগির গুম হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তদন্ত করার জন্য।

আমার সহকর্মীদের মতে, স্বচ্ছতা ও সহযোগিতার বিষয়ে সৌদি আরবের শপথ সত্ত্বেও খাসোগির মৃতদেহের অবস্থান বা তার দেহাবশেষ গুম করার ক্ষেত্রে স্থানীয় কারা সহায়তা করেছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নিজের তুর্কি কর্তৃপক্ষকে দেননি মোজেব। তুর্কি তদন্তকারীরা এমন একটি তথ্য হাজির করতে চাইছেন যে খাসোগির মৃতদেহ এসিডের মাধ্যমে গলিয়ে ফেলা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ এক তুর্কি কর্মকর্তা আমার সহকর্মীদের বলেছেন, ‘খাসোগি হত্যার অপরাধীদের সম্পর্কে তুর্কি কর্তৃপক্ষ কী প্রমাণ জোগাড় করতে পেরেছে প্রাথমিকভাবে সৌদি কর্মকর্তাদের সে বিষয়ে ভালোই আগ্রহ ছিল। এ কারণে তুর্কি কর্মকর্তারা ধারণা করেছিলেন যে, রিয়াদ সত্যিকারার্থেই এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে আগ্রহী।’

খাসোগির স্পষ্টত প্রতীয়মান মৃত্যুর বিষয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষোভ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করার পর সৌদি আরব সময়ক্ষেপণ, অস্বীকার ও বিভ্রান্ত করার মতো অনেক পদক্ষেপ দেখিয়েছে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত। তারপর ঘটনাবশত সৌদি আরব স্বীকার করে যে, খাসোগি তাদের হেফাজতে মারা যায়।

দেশটি ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিকের মৃত্যুর জন্য সৌদি আরবের অপারেশন টিমের সঙ্গে ধস্তাধস্তিকে দায়ী করেছিল, যে অপারেশন টিমটি খাসোগিকে আটক করতে গিয়েছিল। একই সঙ্গে দেশটি এও বলেছে যে, জড়িতদের সৌদি আদালতে বিচার করা হবে।

কিন্তু রিয়াদ এখনও তুরস্কের তদন্তের ফলাফল সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি বা তাদের নিজেদের তদন্তের ফলাফলও জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি।

আজকের ওয়ার্ল্ডভিউর পাঠকরা (ওয়াশিংটন পোস্টের) জানেন, খাসোগি স্ক্যান্ডাল সৌদি আরবের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে এবং ওয়াশিংটন পোস্টের খাসোগির কলামে বারবার সমালোচনার শিকার দেশটির উচ্চাভিলাষী যুবরাজের ভাবমূর্তিরও মারাত্মক ক্ষতি করেছে।

এমবিএস হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ৩৩ বছর বয়সী সৌদি যুবরাজের দৃশ্যমান চিয়ারলিডার হয়ে পড়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; কিন্তু তারপরও রিয়াদ যেভাবে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছে তার সমালোচনায় ফেটে পড়েছেন তিনি।

গত মাসে যখন সৌদি আরবের বারবার পরিবর্তন করা ব্যাখ্যার বিষয়ে চাপ দেয়া হচ্ছিল, তখন ট্রাম্প ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন, ‘নিঃসন্দেহে এতে প্রতারণা রয়েছে, এতে মিথ্যা রয়েছে।’ ‘তাদের বর্ণনাগুলো বাস্তবতার বাইরে’।

তিনি কখনও এমবিএসকে সুরক্ষা দিতে চাননি, যদিও ট্রাম্পের জামাতা জেরাড কুশনারের সঙ্গে এমবিএসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং ইরানকে চেপে ধরার জন্য ট্রাম্পের প্রচেষ্টায় তার সমর্থনও রয়েছে।

ট্রাম্প অবশ্য রিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট না করার কারণ হিসেবে সৌদি আরব মার্কিন কোম্পানিগুলো থেকে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনে থাকে বলে উল্লেখ করেছেন।

ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘তাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়, যিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। আমি এটি ইতিবাচক অর্থে বোঝাচ্ছি।’

ট্রাম্প আরও বলেছিলেন, ‘এমবিএসকে সবচেয়ে শক্তিমান ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং সত্যিকারার্থেই তিনি নিজের দেশকে ভালোবাসেন।’

কিন্তু যেখানে নিজেদের লোককে ফের রিয়াদ পাঠাতে হোয়াইট হাউস আগ্রহী, সেখানে ওয়াশিংটনের বাকি সবাই এ ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহী নয়। খাসোগি হত্যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রখ্যাত অনেকগুলো মার্কিন লবিং ফার্ম সৌদি আরবের সঙ্গে তাদের চুক্তি বাতিল করেছে এবং কিছু দেশের সরকার সম্ভাব্য শাস্তির পথে ধীরগতিতে হেঁটেছে।

তুরস্ক কর্তৃপক্ষের সংগৃহিত প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে দেয়া গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ব্রিফিং আমলে নিয়ে সিনেটরসহ অনেক কংগ্রেসম্যান তীব্রভাবে রিয়াদের সমালোচনা করেছেন।

বুধবার রিপাবলিকান সিনেটরদের একটি দল সৌদি আরব-যুক্তরাষ্ট্র বেসামরিক পরমাণু চুক্তির বিষয়ে আলোচনা বাতিল করে দেয়ার জন্য হোয়াইট হাউসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

ওয়াশিংটনের অন্য আইন প্রণেতারা সৌদি আরব, বিশেষত এমবিএসের ওপর তাদের ক্ষোভ ঝেড়েছেন, যার বন্দি দমনপীড়ন প্রথাগত সৌদি নিয়মনীতিকে ছাড়িয়ে গেছে।

‘সৌদি আরবের মিত্র ও গ্রাহকরা যুবরাজ মোহাম্মদের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার বিপদ উপলব্ধি করতে পারছেন, যিনি বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে তিনি বেপরোয়া ও নির্মম হতে পারেন’- লিখেছেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোহামাদ বাজ্জি।

তিনি আরও লিখেছেন, ‘যারা যুবরাজের অনুকম্পায় থাকেন তারা আশা করেন যে তিনি আনুগত্যের পুরস্কার দেবেন, বিশেষত যখন কয়েক দশকের জন্য তিনি নিজেকে সৌদি আরবের পরবর্তী বাদশার আসনে বসাবেন।’

খাসোগি হত্যাকাণ্ডে সৃষ্ট সংকট এমবিএসের নিজের অবস্থানকেই প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমার সহকর্মীরা যেমন দীর্ঘ তথ্যাদি রিপোর্ট করেছেন, ক্রাউন প্রিন্স তার পাওয়ারের চূড়ায় পৌঁছেছেন বেপরোয়াভাবে আদালতকে পাশ কাটিয়ে, রাজ পরিবারের প্রতিদ্বন্দ্বীদের, এমনকি ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু প্রিন্সকেও গ্রেফতার করা বা বশে আনার মধ্য দিয়ে।

এখন অবশ্য নিজের ছেলেকে লাগাম পরানোর জন্য চাপ চলে গেছে তার পিতা, বয়স্ক বাদশাহ সালমনের ওপর। আমার সহকর্মীরা লিখছেন, ‘এখন প্রশ্ন হল, বাদশাহ কি দক্ষতার সঙ্গে যুবরাজ মোহাম্মদের ক্ষমতা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেবেন, নাকি অন্তত তেমনটি করার ভান করবেন?’

গ্রেফতারের ভয়ে বিদেশে বসবাস করা বাদশাহর এক ছোট ভাইয়ের সৌদি আরবে ফিরে যাওয়ার খবর এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পূর্বাভাস কৌশলে কাজে লাগানোর গুজবের ভিত্তি দিচ্ছে।

সম্ভাব্য একটি দৃশ্য হতে পারে যে একাধিক জ্যেষ্ঠ আত্মীয়ের সঙ্গে এখন ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে দেখা যাবে যুবরাজকে, যাতে করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সৌদি আরবের আস্থা পুনরুদ্ধারে তারা কাজ করতে পারেন।

‘এখন কিছু আমেরিকান, এমনকি সেটা হতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে, সৌদিদের বলতে যাচ্ছেন যে তোমাদের একে (যুবরাজ) গার্ড দিতে হবে এবং এটি করার সবচেয়ে ভালো উন্মুক্ত পথ হতে পারে রাজ পরিবারের জ্যেষ্ঠ কোনো সদস্যকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা।’ টেক্সাসের এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটির বিষেশজ্ঞ গ্রেগরি গস এমনটিই বলেছেন হাফিংটন পোস্টকে।

যে প্রশাসন ইয়েমেনে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ উসকে দেয়া, কাতার অবরোধ করে আঞ্চলিক সংকট ঘনিভূত করা এবং লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে আটকের মতো নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এমবিএসকে দিয়েছে বলে মনে করা হয়, সে প্রশাসন একটি সীমায় পৌঁছতে পারে।

৩০ দিনের মধ্যে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করে ফেলার আহ্বান এ সপ্তাহেই জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জ্যাম ম্যাটিস।

অতীতে যখন ইয়েমেন যুদ্ধ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছিল সৌদি আরব, তখন ট্রাম্প প্রশাসন রিয়াদকে সুরক্ষা দিতে উঠেপড়ে লেগেছিল, এমনকি সৌদি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কয়েক ডজন ইয়েমেনি স্কুল শিশুকে হত্যা করেছে- এমন প্রমাণের পরও তাতে ছেদ পড়েনি। কিন্তু খাসোগি হত্যার পর অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়েমেনি স্কলার এলিজাবেথ কেন্ডল ওয়াশিংটন পোস্টের সুদর্শন রগভনকে বলেছেন, ‘ইয়েমেনের যুদ্ধ সন্দেহের সৌদি ভারসনের দরজা (খাসোগি হত্যাকাণ্ড) পুরোপুরি খুলে দিয়েছে।

ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে অনুবাদ : সাইফুল ইসলাম

ইশান থারুর : পররাষ্ট্রনীতি, ভূরাজনীতি ও ইতিহাসবিষয়ক রিপোর্টার

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version