এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একই সঙ্গে নির্বাচনের তফসিল এক মাস পিছিয়ে দেয়ারও দাবি জানিয়েছে নতুন এই জোট। রোববার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়। এতে আরও বলা হয়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে এই নির্বাচনে যাচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট।

সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জোটের মুখপাত্র ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর আগে সূচনা বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য, মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এই নির্বাচনে অংশ নেব।’

তিনি অতীতের নির্বাচনগুলোর উদাহরণ দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল এক মাস পিছিয়ে নতুন তফসিলের দাবি জানান। এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও জবাব দেন ড. কামাল হোসেন। ড. কামাল হোসেন জানান, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে জোটের প্রতীক কী হবে, কে কোন আসন থেকে নির্বাচন করবেন, মনোনয়ন ফরম বিক্রিসহ যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এরপর তা গণমাধ্যমকে জানানো হবে। নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ না থাকলে কী করবেন- জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা আন্দোলনে আছি, আন্দোলন অব্যাহত রাখব। প্রয়োজনে আমরা আইনের আশ্রয় নেব। দরকার হলে আদালতেও যাব।’ কোনো প্রতিকার না পেলে নির্বাচন বর্জন করবেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখা যাক।

লিখিত বক্তব্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘গণতন্ত্রের সংকট সমাধানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সবসময় আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। সেই লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সরকারকে চিঠি দিয়ে সংলাপে আহ্বান জানায়। সেই আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি দলের আমন্ত্রণে ১ ও ৭ নভেম্বর গণভবনে দুই দফা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুঃখজনকভাবে এই সংলাপে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বর্তমানের গভীর সংকট থেকে উত্তরণের পথে ন্যূনতম সমঝোতা করার মানসিকতা আমরা দেখতে পাইনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে ৭ দফা দাবি আমরা সরকারের কাছে পেশ করেছিলাম, সেগুলোর প্রায় সবই তারা নাকচ করেছেন। এমনকি বর্তমান সংবিধান সংশোধন না করেও যে দাবিগুলো পূরণ করা যায়, তার প্রায় সবকটির ব্যাপারে তারা কোনো আশ্বাস তো দেনইনি, উপরন্তু সেগুলোর কয়েকটিকে সংবিধানবহির্ভূত বলেও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন।’

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘উভয় পক্ষের মধ্যকার দুই দফা সংলাপে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আশ্বাস দিয়েছিলেন বিরোধীদের সভা-সমাবেশ করার ওপর কোনো রকম বিধিনিষেধ থাকবে না এবং গায়েবি মামলাসহ নানা রকম রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের মুক্তি দেয়া হবে এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের হয়রানিমূলক মামলা আর দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর প্রথম আশ্বাসের পরেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দুইটি জনসভা হয়েছে। এর একটি ঢাকায় ও অপরটি রাজশাহীতে। দুইটি জনসভারই লিখিত অনুমতি দিতে দেরি করে এবং সরকারি মদদপুষ্ট পরিবহন সংকট তৈরি করে মানুষের জনসভায় অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। রাজশাহীতে জনসভা হওয়ার দু’দিন আগে থেকে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। এমনকি রাজশাহীর সঙ্গে আশপাশের অনেক জেলার বাস যোগাযোগ বন্ধ ছিল।’

তিনি বলেন, ‘দুই দিনের জনসভাকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী হয়রানিমূলক গ্রেফতার বন্ধের আশ্বাস দেয়ার পর একদিনে ১২শ’রও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যে দুইটি বিষয়ে সরকারপক্ষ আশ্বাস দিয়েছিলেন, সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যখন অবিশ্বাস্য রকম বৈপরীত্য দেখা যায়, তখন আমাদের এটা ধরে নিতেই হয়, সরকার আসলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে ন্যূনতম সমঝোতা করার ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিল না।’

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবিকৃত সাত দফার বিস্তারিত বিচার-বিশ্লেষণের জন্য আরও আলোচনার প্রয়োজন ছিল। সেজন্য আমরা উভয়পক্ষের মধ্যে আরও কয়েকটি সংলাপ চেয়েছিলাম এবং সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তফসিল না ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি।’

তিনি বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের আনন্দ মিছিল প্রমাণ করে, নির্বাচন কমিশন প্রকৃতপক্ষে সরকারের চাহিদামতো তফসিল ঘোষণা করেছে। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয়, সরকারের যাবতীয় চেষ্টার উদ্দেশ্য হল- জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আদলে আরেকটি নির্বাচন করা।’

নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে লিখিত বক্তব্যে ড. কামাল বলেন, ‘নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও বিটিভিসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালানো হচ্ছে, যা নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে সাবেক নির্বাচন কমিশনারসহ দেশের প্রায় সব দল ও জনগণের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সরকার ও নির্বাচন কমিশন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত বাতিল করেনি। এরকম একটি পরিস্থিতিতে একটা অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই কঠিন। কিন্তু এরকম ভীষণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের অংশ হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সাত দফা দাবি থেকে আমরা সরে আসছি না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নির্বাচনের তফসিল পিছিয়ে দেয়ার দাবি। আমরা নির্বাচনের বর্তমান তফসিল বাতিল করে এক মাস পিছিয়ে নতুন তফসিল ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। সে ক্ষেত্রেও বর্তমান সংসদের মেয়াদকালেই নির্বাচন করা সম্ভব হবে।’ এ সময় ২০০৮ সালের নির্বাচনে দুইবার তফসিল পিছিয়ে দেয়ার উদাহরণ উল্লেখ করেন তিনি।

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় দায়িত্ব সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনে অংশ নেয়ার পাশাপাশি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আচরণের প্রতি কড়া নজর রাখবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জনগণের দাবি মানা না হলে উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় সরকার ও নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তথাকথিত নির্বাচন মানুষের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার, স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার ক্ষমতাকেও হরণ করেছে। নিশ্চিতভাবেই আগামী নির্বাচনটি এই দেশের মানুষের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের নির্বাচন হবে। সেই লক্ষ্যে মানুষ তার নিজের ভোটাধিকার সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করার জন্য ভোটের ময়দানে থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশে গণতন্ত্রের যে গভীর সংকট তৈরি হয়েছে, সেই সংকট দূর করে আমাদের ঘোষিত ১১ দফা লক্ষ্যের ভিত্তিতে একটি সুখী, সুন্দর আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংগ্রামে দেশের জনগণ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পাশে থাকবে।’

এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিসহ সাত দফা থেকে তারা সরে আসেননি; আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা ভোটে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বর্তমান তফসিল বাতিল করে নির্বাচন এক মাস পিছিয়ে দিয়ে নতুন তফসিল ঘোষণার দাবি করছি। সেই ক্ষেত্রেও বর্তমান সংসদের মেয়াদকালেই নির্বাচন করা সম্ভব হবে।’

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার মুহাম্মদ জমিরউদ্দিন সরকার, জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সুলতান মো. মনসুর আহমদ, গণস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন, গণফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক, আওম শফিক উল্লাহ প্রমুখ।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version