হামিদ-উজ-জামান : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশনের (এমসিসি) মূল্যায়নে চার ধাপ অবনতি ঘটেছে বাংলাদেশের। সম্প্রতি সংস্থাটির প্রকাশ করা স্কোর কার্ড-২০১৯-এ দুর্নীতিসহ ১১ সূচকে রেড জোনে আছে বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশ ৭টি সূচকে রেড জোনে ছিল।

মোট ২০টি সূচকের অধিকাংশই লাল তালিকাভুক্ত হওয়ায় এবারও মিলছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডের (এমসিএফ) অনুদান। স্কোর কার্ডের উন্নতির ভিত্তিতে কোনো দেশকে এ ফান্ডে যুক্ত করা হয়।

রেড জোনে থাকা ১১টি সূচক হচ্ছে- দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসা শুরুর পরিবেশ, বাণিজ্য নীতিমালা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা, জমির অধিকার ও প্রাপ্যতা, অর্থনীতিতে নারী ও পুরুষের সমতা, ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ, তথ্যপ্রাপ্তির স্বাধীনতা, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়, প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা।

এর মধ্যে যে চারটি সূচক গত বছরের মূল্যায়নে সবুজ তালিকায় থাকলেও এবার রেড জোনে উঠে এসেছে সেগুলো হল- দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা, অর্থনীতিতে নারী ও পুরুষের সমতা এবং ব্যবসা শুরুর পরিবেশ। আর গ্রিন জোন বা সবুজ তালিকায় থাকা ৯টি সূচক হচ্ছে- রাজস্ব নীতি, মূল্যস্ফীতি, টিকা দেয়ার হার, মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার হার, শিশু স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক অধিকার, বেসামরিক লোকের স্বাধীনতা, সরকারের কার্যকারিতা এবং আইনের ভূমিকা।

চলতি বছরের এমসিসির মূল্যায়ন নিয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও আমেরিকা ডেস্কের প্রধান শহিদুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, এখনও অফিসিয়ালি বিষয়টি আমাদের জানানো হয়নি। জানার পর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে। তবে গত বছর দুর্নীতির সূচকটি গ্রিন জোনে থাকায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এমসিসির বোর্ডসভায় বাংলাদেশকে অনুদান দেয়ার বিষয়টি উঠেছিল। তখন ব্যাপক প্রচেষ্টাও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু অনুদান পাওয়া যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান রোববার বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক হলেও এমসিসির মূল্যায়নে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। সংস্থাটি যেসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করেছে আমি মনে করি তা যথার্থ। দুর্নীতিসহ অন্যান্য সূচকে খারাপ করায় এমসিএফ থেকে যে সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের উচিত বিশেষ নজরদারি করে এ অবস্থার উন্নতি ঘটানো।

জানতে চাইলে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল কমপিটিটিভনেস ইনডেক্সে অন্যান্য বছর প্রধান চারটি সমস্যার মধ্যে উপরের দিকে থাকত বিদ্যুৎ সমস্যা। কিন্তু এবার এক নম্বর সমস্যা হিসেবে উঠে এসেছে দুর্নীতি। তারপরই রয়েছে বিদ্যুৎ, অবকাঠামো ও আমলাদের অদক্ষতার বিষয়টি। এমসিসির মূল্যায়নেও তাই দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া এমসিসির স্কোর কার্ডে যেগুলো বলা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টেও সেসবের বেশিরভাগ উঠে এসেছে।

যেমন: জমি প্রাপ্যতার বিষয়টি, ব্যাংকিং খাতে উন্নতি হয়নি বরং রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের অনুমোদন এবং ঋণখেলাপি বেড়ে গেছে। অন্যদিকে বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রে কিছুটা উল্টো পথেই চলছে। বাণিজ্য উদারীকরণ না করে বরং কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশের চেয়েই পিছিয়ে বাংলাদেশ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ড (এমসিএফ) গঠন করে এবং এটি পরিচালনার জন্য ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি)। ফান্ড গঠনের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। স্টেট ডিপার্টমেন্ট দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে নির্বাচিত দেশগুলোকে সহায়তা করে থাকে। একটি হচ্ছে কম অঙ্কের সহায়তার দেশ। এর আওতায় সাধারণত ১০-৪০ কোটি ডলার পর্যন্ত অনুদান দেয়া হয়ে থাকে। অন্যটি হচ্ছে বড় অঙ্কের সহায়তা। এর আওতায় ৫০ কোটি ডলার থেকে বিভিন্ন অঙ্কের অনুদান দেয়া হয়ে থাকে। এ জন্য প্রতিবছর বৈঠক করে এমসিসি।

এমসিএফ নিয়ে ব্যাপক তৎপরতা চালানো অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খান যুগান্তরকে বলেন, এমসিসির মূল্যায়নে অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক ভালো করলেও শুধু সুশাসন ও দুর্নীতিতে খারাপ করলে কখনও এ ফান্ডে যুক্ত হওয়া যাবে না। সূত্র জানায়, প্রথমদিকে ১৭টি নির্দেশক থাকলেও ২০১২ সালে তা ২০টি করা হয়। ওই বছরই প্রথমবারের মতো এ ফান্ডে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।

তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরের সময় ওই ফান্ডে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তাকে অনুরোধ জানানো হয়। পরবর্তী সময়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে এক বৈঠকে অংশ নিয়েছিল সরকারের প্রতিনিধি। বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এর মধ্যে এমসিএফের বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে টেকনিক্যাল টিম পাঠাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু টেকনিক্যাল টিম পাঠানো হলেও চ্যালেঞ্জ ফান্ডে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আর এগোয়নি।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version