এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মাঠে গড়াতে আর ৩৫ দিন বাকি। ভোটযুদ্ধে অংশ নিতে রাজনৈতিক দলগুলো কাটাচ্ছে দিন-রাত ব্যস্ত সময়। মনোনয়ন, নির্বাচনী প্রচারণা সবকিছু এখন তাদের ভাবনাজুড়ে। একই সঙ্গে দুই প্রধান জোট একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলছে। গত সপ্তাহে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে একাধারে বেশকিছু অভিযোগ দায়ের করে বিরোধী বৃহৎ জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। অন্যদিকে এসব অভিযোগের নামে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে বলে পাল্টা অভিযোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট। দুই জোটের পাল্টাপাল্টি এ অবস্থানের কারণে স্বাভাবিকভাবে সবার দৃষ্টি রেফারির ভূমিকায় থাকা নির্বাচন কমিশনের দিকে। সূত্র : মানবজমিন।
বিশিষ্টজনরা বলছেন, নির্বাচনকালীন সময়ে বিরোধী দলগুলো যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিগ্রহের শিকার হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।
তারা এও বলছেন, এই নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের যে ভূমিকা থাকার কথা ছিল তা না থাকায় তাদের প্রতি সেই আস্থা জন্মেনি।
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে বিগত বছরগুলোতে নির্বাচন কমিশন একাধিকবার ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হলেও সেই কমিশনের হাত ধরেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপি, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তারসহ নানা ‘দৃশ্যমান’ অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও ভোটগ্রহণ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছিলেন, নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ হয়েছে। সে অনুযায়ী এই ইসিকে নিয়ে এবারও সংশয় জেগেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠা তফসিল ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার বন্ধ হয়নি বলে দাবি করেছে তারা। এর মধ্যে গ্রেপ্তার বন্ধে হস্তক্ষেপ নিতে দলগুলো একাধিকবার চিঠিও দিয়েছে।
তবে তাতে কোনো প্রতিকার পায়নি। নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে সম্প্রতি যে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সেটি হলো ভোটগ্রহণের সময় পর্যবেক্ষকদের ওপর নানা রকম বিধি-নিষেধ আরোপ করা। ভোটকেন্দ্রে পর্যবেক্ষকদের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দেয়ার বিষয়টি ‘সঠিক নয়’ বলেই উল্লেখ করেছেন বিশিষ্টজনেরা। অন্যদিকে প্রশাসনের রদবদল চেয়ে বৃহস্পতিবার ইসিকে চিঠি দিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। কিন্তু সিইসির সঙ্গে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের মতবিনিময় শেষে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া তাদের বদলি করা হবে না- এমন নিশ্চয়তা দেয়া হয়। এর আগেও দুই দফা ঐক্যফ্রন্ট প্রশাসনের রদবদলের দাবি জানিয়েছিল। তখন ইসি বলেছিল, ঢালাওভাবে প্রস্তাব দিলে ইসি তা গ্রহণ করবে না।
কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সুনির্দিষ্টভাবে তা জানালে ইসি খতিয়ে দেখবে। এরপর গত বৃহস্পতিবার প্রশাসন ও পুলিশের ৯২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিতভাবে অভিযোগ করে ঐক্যফ্রন্ট। অন্যদিকে নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই সামনে আসছে ততই রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। পাশাপাশি ইসির ভূমিকা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।
রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব বলেই মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। একটি বেসরকারি টিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রয়োজন। যতই রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করবে ততই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো। যদি বিরোধী দলগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিগ্রহের শিকার হতে হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। এজন্য নির্বাচন কমিশন কতটুকু তার অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে সেটা নির্বাচন কমিশনের যোগ্যতার ওপর নির্ভর করবে।
দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, আমাদের জন্য ইতিবাচক দিক দুটো। প্রথমত রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। আর দ্বিতীয়ত হলো কোনো সংঘাত- অবরোধ নেই।
কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ যেটা সেটা হলো নির্বাচনে সমপক্ষতা নিশ্চিত হবে কিনা। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়া মানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন। এটাও বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এগুলো মোকাবিলা করে নির্বাচন কমিশন সমপক্ষতা নিশ্চিত করতে পারবে কিনা। অবশ্য কমিশনের নিরপেক্ষতা, সাহসিকতা এবং দৃঢ়তা থাকা উচিত। পর্যবেক্ষকদের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টিকে ‘অযৌক্তিক’ মনে করে সুজন সম্পাদক বলেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকার কথা বলার বিষয়টি অযৌক্তিক।
তবে পর্যবেক্ষকদের নির্বাচনকে যেন কোনোভাবে প্রভাবিত না করে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের দ্বারা নির্বাচনী কাজ যেন কিছুতেই ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে তারা ছবি তুলতে পারবে না এটা ঠিক নয়। কারণ তাদের ইভিডেন্স (প্রমাণ) দরকার। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন মূল্যায়ন করবে বলে আশা করি। গত বৃহস্পতিবার রাতেও রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদী থেকে যশোর বিএনপি নেতার লাশ উদ্ধার হয়েছে। নির্বাচনকালীন এমন ঘটনায় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া প্রসঙ্গে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শুধু এটা নয়, গ্রেপ্তারও চলছে।
এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কার্যকরী ভূমিকাই জরুরি। তারা কি ভূমিকা পালন করে সেটা দেখার বিষয়। ভোটের চূড়ান্ত লড়াইয়ে যেতে বাকি থাকা এই সময়ের মধ্যে কতটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব এমন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, এটা বোঝা যাবে আগামী কয়েকদিন পর। তবে এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে তারা যে নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে সেই আস্থাটা জন্মাচ্ছে না। যেহেতু এখনো পাঁচ সপ্তাহ বাকি, দেখা যাক আগামী ২ থেকে ৩ সপ্তাহে তারা কী পদক্ষেপ নেয়। জনগণ নিঃসন্দেহে সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এবং সাহায্য সহযোগিতাও করবে। এখন এটা নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা আর নিরপেক্ষতার উপরে।
আমার ধারণা আগামী তিন সপ্তাহে ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হবে আসলে কোন্দিকে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের ভোটগ্রহণের দিন কার্যক্রমে বিধি-নিষেধ আরোপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো এক ধরনের উদ্ভট সিদ্ধান্ত। তবে আশা করি, যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে পর্যবেক্ষকদের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত পাল্টাবে। বিরোধী দলগুলোর মামলা ও গ্রেপ্তার, ইসির কাছে প্রশাসনের রদবদল এবং বৃহস্পতিবার বুড়িগঙ্গায় বিএনপি নেতার লাশ উদ্ধারের ঘটনা প্রসঙ্গে শাহদীন মালিক বলেন, এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় তাদের (নির্বাচন কমিশন) প্রতি আস্থা এখনো সৃষ্টি হয়নি। আগামী তিন সপ্তাহে যদি তারা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেন তাহলে আস্থা তৈরি হবে।