এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় নির্বাচন কমিশনে আপিলের স্তূপ জমেছে। দুইদিনে ৩১৯ জন প্রার্থী আবেদন করেছেন। আজও আপিল আবেদন গ্রহণ করবে নির্বাচন কমিশন। কাল থেকে তিনদিন চলবে আপিল শুনানি। কমিশন সূত্র বলছে, রেকর্ড আবেদন পড়তে পারে শেষদিন পর্যন্ত। তিনদিনে এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে হিমশিম খেতে হবে ইসিকে। আপিল নিষ্পত্তির জন্য এজলাস স্থাপন করা হয়েছে। একক এজলাসে চলবে শুনানি।

ইসি সূত্র বলছে, আপিল নিষ্পত্তি করতে প্রার্থী প্রতি খুব বেশি সময় মিলবে না। এ নিয়ে প্রার্থীরাও রয়েছেন শঙ্কায়। তারা বলছেন, কিছু বিষয়ে আইনি যুক্তিতর্কের প্রয়োজন রয়েছে। আপিলে নির্বাচন কমিশনকে সে সুযোগ দিতে হবে।

প্রার্থিতা ফিরে পেতে গতকালও ২৩৪ জন প্রার্থী আবেদন করেছেন। এ ছাড়া মনোনয়ন গ্রহণের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন একজন সংক্ষুব্ধ প্রার্থী। আপিল আবেদনের প্রথম দিন সোমবার ৮৪টি আবেদন জমা পড়ে। আবেদন করাদের মধ্যে বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে। গতকাল আটটি বিভাগে মোট আপিল আবেদন জমা পড়ে ২৩৫টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৬৮টি আপিল আবেদন হয়েছে। বিভাগওয়ারি হিসেবে আপিল আবেদনের সংখ্যায় এর পরেই রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। সেখানে মোট ৫৬ জন প্রার্থী আবেদন করেছেন। এ ছাড়া সিলেট বিভাগে ১৫, রাজশাহী বিভাগে ২২, রংপুর বিভাগে ২৮, বরিশাল বিভাগে ১২, খুলনা বিভাগে ১৮ ও ময়মনসিংহ বিভাগে মোট ১৬টি আপিল আবেদন জমা পড়ে। সকাল থেকেই আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে অস্থায়ী বুথে আপিল আবেদন জমা দিতে আসেন প্রার্থীরা। সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত আপিল আবেদন জমা নেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।

ঋণ খেলাপি, ত্রুটিপূর্ণ মনোনয়ন, ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়া, হলফনামায় স্বাক্ষর না থাকা, লাভজনক পদে থাকা, আয়কর রিটার্ন দাখিল না করা, সমর্থকদের স্বাক্ষর ও তালিকায় গরমিল এবং সরকারি সেবা সংস্থার বিল পরিশোধ না করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আপিল আবেদন করেন প্রার্থীরা। তবে ঋণখেলাপি, আয়কর রিটার্ন না দেয়া, স্বাক্ষরে গরমিল ও ফৌজদারি মামলায় সাজার কারণে সবচেয়ে বেশি আপিল জমা পড়ে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর ও তালিকায় গরমিল থাকায় আপিল আবেদন করেন অধিকাংশ প্রার্থী। তবে আপিল আবেদন জমা নেয়ার দ্বিতীয় দিন প্রথম দিনের তুলনায় অনেকটা সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়। মূলত কমিশন ভবনের সামনে প্রতিটি বিভাগের জন্য আলাদা বুথ তৈরি করে দেয়ায় প্রথম দিনের তুলনায় অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যে আপিল আবেদন জমা দেন প্রার্থীরা। মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা হওয়ার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনে আপিল আবেদন করা প্রার্থীদের বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট প্রার্থীও ছিলেন। মঙ্গলবার সকালে আপিল আবেদন করেন, নাটোর-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। ফৌজদারি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার অভিযোগে মনোনয়ন বাতিল করা হয় এই বিএনপি প্রার্থীর। পটুয়াখালী-১ আসনে ঋণখেলাপির অভিযোগে মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় আপিল করেন জাতীয় পার্টির সদ্য পদচ্যুত মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। তার পক্ষে আইনজীবী নজরুল ইসলাম দুপুরে আপিল আবেদন জমা দেন।

তিনি জানান, মিথ্যা অভিযোগে রুহুল আমিন হাওলাদারের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছিল। এ ছাড়া হবিগঞ্জ-১ আসনে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের বার্ষিক নবায়ন ফি জমা না দেয়ার কারণে মনোনয়ন বাদ পড়া গণফোরামের প্রার্থী ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়ার পক্ষে তার প্রতিনিধি শাহরিয়ার শুভ আপিল করেন। এ ছাড়া, বিকালে আপিল আবেদন জমা দেন যশোর-২ (ঝিকরগাছা ও চৌগাছা) আসন থেকে মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা হওয়া বিএনপির প্রার্থী ও উপজেলা চেয়ারম্যান সাবরিনা সুলতানা। দুদকের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন স্থানীয় রিটার্নিং কর্মকর্তা। উচ্চ আদালতের স্টে অর্ডারের কপি সংযুক্ত করে শুনানির জন্য আপিল আবেদন করেন বিএনপির এই প্রার্থী। এ ছাড়া ঢাকা-২ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী আমান উল্লাহ আমানের পক্ষে আপিল করেন তার ছেলে ব্যারিস্টার ইরফান ইবনে আমান অমি।

ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় তার মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সাজার কারণে বাতিল হওয়া ময়মনসিংহ-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান চিকিৎসক নেতা এজেডএম জাহিদ হোসেন তার প্রার্থিতা ফিরে পেতে সকালে আপিল জমা দেন। এ ছাড়া, ৪১৪৭ টাকার পল্লী বিদ্যুতের বিল অপরিশোধিত থাকায় বরিশাল-২ আসনে মনোনয়ন বাতিল হওয়া মহাজোটের প্রার্থী, চিত্রনায়ক ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী পারভেজ সোহেল রানা, কুড়িগ্রাম-৪ আসনের দুই প্রার্থী মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে আপিল করেন। এরা হলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. জাকির হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ইমরান এইচ সরকার। চট্টগ্রাম-৫ আসনে আপিল আবেদন করেন বিএনপি নেতা মীর নাসিরউদ্দিনের ছেলে ও বিএনপি প্রার্থী মীর হেলাল।

এদিকে মঙ্গলবার প্রার্থীদের আপিল গ্রহণ করা আট বিভাগের ডেস্কগুলো পরিদর্শন করেন ইসি কমিশনার মাহবুব তালুকদার। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপিলকারীদের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করা হবে না। গত ২রা ডিসেম্বর ছিল মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন। যাদের মনোনয়নপত্র বৈধ-অবৈধ হয়েছে, তাদের আপিলের শুনানি আগামী ৬ই ডিসেম্বর থেকে ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে। ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এক্ষেত্রে আদালতের মতোই শুনানি করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশন একটি আধাবিচারিক সংস্থা। নির্বাচন কমিশনারদের মর্যাদাও হাইকোর্টের বিচারপতিদের সমান। শুনানিতে আপিলকারীরা তাদের আইনজীবী নিয়ে আসতে পারবেন।

সেখানে আদালতের বেঞ্চ’র মতো করেই তারা মুভ করবেন। সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনই আপিল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করে। সংক্ষুব্ধরা ইসির সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হলে আদালতেও যেতে পারবেন। আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের ১১ তলায় শুনানি হবে। ২৮শে নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিনে ৩০৬৫টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল। এর মধ্যে দলীয় মনোনয়নপত্র জমা পড়ে মোট ২ হাজার ৫৬৭টি ও স্বতন্ত্র ৪৯৮টি। ২রা ডিসেম্বর ছিল মনোনয়নপত্র বাছাই। ওইদিন ২ হাজার ২৭৯টি মনোনয়নপত্র বৈধ ও ৭৮৬টি অবৈধ বলে ঘোষণা করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এগুলোর মধ্যে বিএনপির ১৪১টি, আওয়ামী লীগের ৩টি এবং জাতীয় পার্টির ৩৮টি মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে ৩৮৪টি। আগামী ৯ই ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। ১০ই ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ এবং ৩০শে ডিসেম্বর ভোট হবে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version