এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, গত ১০ বছরে অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার গুণগত মান কমে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। অর্থাৎ সামগ্রিক উন্নয়নের পাশাপশি বৃদ্ধি পেয়েছে বিভাজিত বৈষম্য। এসব বেড়েছে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা না থাকা ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে। এজন্য প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে বিভাজিত বৈষম্য কমানোর আহ্বান জানিয়েছে সিপিডি।

এছাড়া আগামী নির্বাচনে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থায়নের পদ্ধতি ইশতেহারে তুলে ধরার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। এদিকে নির্বাচন এখন বড় বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে। ফলে যোগ্য ও সৎ প্রার্থীরা মনোনয়ন পাচ্ছে না বলেও মনে করেছে সিপিডি। গতকাল ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চলনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, রিসার্চ ফেলো তৌফিক ইসলাম খান।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ১০ বছরে উন্নয়নের ধারায় বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু প্রথম ৫ বছরের চেয়ে দ্বিতীয় ভাগের ৫ বছরে এসে অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার গুণগত মান কমেছে আর দ্রুত বেড়েছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন উদ্যোগেও বেশ ঘাটতি দেখা গেছে। গত ৫ বছরে দেশের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা কমে যাওয়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে পারে বলেও ধারণা সিপিডির। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক হলেও জীবন ও জীবিকা সম্পর্কিত বিষয়গুলো আলোচনার জন্য উঠে আসেনি। তাই আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়গুলো স্পষ্ট করার পাশাপাশি মানুষের জীবন মান বাড়ানোর বিষয়কে স্থান দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। গত ১০ বছর ধরে ছড়ানো ছিটানো উন্নয়ন এবং ব্যাপক বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বৈষম্যকে হ্রাস করা।

দেবপ্রিয় বলেন, আমরা আগেই বলেছি নির্বাচনটা অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে। এখানে যতখানি না মানুষের ভোটাধিকার, তার থেকে বেশি ওইখানে (বিনিয়োগ) গেছে। নির্বাচনী ব্যয় এখন অনেক সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে বাধ্য করছে। এ ব্যয় নিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সামর্থ্য নেই।
নির্বাচনী ব্যয় গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠছে কি না তা এখন বড় বিষয়- এমন মন্তব্য করে দেবপ্রিয় বলেন, নির্বাচনী ব্যয়কে আগামীতে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য করা যায় কি না দেখতে হবে। নির্বাচনী ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে। নির্বাচনী ব্যয়ের যে ঘোষণা দেয়া হয়, তা পরে পরিবীক্ষণ করার আগ্রহ বা সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে বলে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কাছে মনে হয়নি।

তিনি বলেন, হলফনামায় সম্পদের যে বিবরণ দেয়া হয় তা আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই থেকে যায়। এটাকে দলিল হিসেবে তার সত্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ কেউ নেয় না। নির্বাচন কমিশনের সেই সক্ষমতা না থাকলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেই সক্ষমতা রয়েছে। সুতরাং এটা তাদের আগ্রহের বিষয় হওয়া উচিত।

ঋণখেলাপির বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ঋণখেলাপি হিসেবে যারা ধরা পড়েছেন, তাদের ঋণের পরিমাণ খুব বড় বিষয় না। আমরা প্রকাশ্যভাবে যেটুকু জানি, সেটা হলো- সব থেকে বড় বড় ঋণ গ্রহীতা যারা নির্বাচনে এসেছেন তারা বহু আগেই তাদের ঋণের প্রভাবগুলো অন্যান্য সংযোগ ব্যবহার করে ঋণকে সমন্বয় অথবা অন্য কোনো ব্যবস্থায় নতুন একটি ঋণ দিয়ে সেই ঋণের অর্থায়ন করে রেখেছেন। অর্থাৎ লোক দেখানো একটা ব্যবস্থার এর মধ্যে চালু রয়েছে। সেটার প্রকৃত মূল্যায়ন করার জায়গা হয় তো নির্বাচন কমিশনের নয়, সেটা দেখভাল করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এর জন্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার যে সমন্বয় থাকার কথা ছিল, সেটা আমরা দেখি না।

দেবপ্রিয় বলেন, গত এক দশ ধরে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়কালে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষিত হয়েছে, ভৌত অবকাঠামো খাতে বড় ধরনে বিনিয়োগের ফলে জ্বালানি সংকট অনেকখানি নিরসন হয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে ব্যাপকতা প্রয়োজন ছিল সেটাও অনেকখানি বিস্তৃত হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখেছি সামাজিক সুরক্ষার জন্য এক ধরনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা সেটাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়েছে। সমগ্রিকভাবে এই সময়কালে (২০০৮-১৮) বাংলাদেশের বড় ধরনের উন্নয়ন আমরা লক্ষ্য করেছি।

তিনি বলেন, আমরা দেখেছি অর্থনীতির গুণগতমান দ্বিতীয়ভাগে (২০১৪-১৮) এসে প্রথমভাগের তুলনায় পতন ঘটেছে। সামাজিক বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া সরকারের নতুন ধরনের নীতি নিয়ে নতুন উদ্যোগে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে উদ্যম, সেই উদ্যমেও আমরা কিছুটা ঘাটতি লক্ষ্য করেছি। এর বড় একটি কারণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা কমে যাওয়ার কারণে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা কমে গেছে।

দেবপ্রিয় বলেন, নির্বাচনী আলোচনায় কোনো অর্থনৈতিক বিষয় আসেনি। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচনী প্রক্রিয়া যেভাবে আগাচ্ছে, তাতে নির্বাচন কিভাবে হবে? কেমন করে হবে? কারা করবে? কীভাবে করবে? এসব বিষয়ের প্রাধান্য রয়েছে। জীবন-জীবিকার বিষয় কিন্তু এখনো এই নির্বাচনী বিতর্কের মধ্যে স্থান লাভ করেনি। এটি বড় একটি পরিতাপের বিষয়।

নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয়ে তিনি বলেন, মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো যখন নির্বাচনী ইশতেহার দিবেন তাকে শুধু এটা বললে হবে না উনারা কী চান। ওনারা কীভাবে এটা অর্জন করবেন, সে কথাটিও বলতে হবে। উনারা অনেক গগনস্পর্শী আকাঙ্ক্ষা আমাদের সামনে তুলে ধরবেন। কিন্তু সেটাকে অর্জন করার পদ্ধতি, তার অর্থায়নের সুযোগ একই সঙ্গে তাদের বলতে হবে।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে কর-জিডিপির হার কমেছে। ২০১৪ সালে কর-জিডিপির হার ছিল ১০.৪০ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১০.২০ শতাংশ। এই কর-জিডিপির হার কমার অন্যতম কারণ কর বহির্ভূত রাজস্ব কমে যাওয়া। ২০১৪ সালে কর বহির্ভূত রাজস্ব ছিল জিডিপির ১.৮০ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১.২০ শতাংশ।

এ সময় তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে রাজস্ব আয় বাড়ার লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে তার সুনির্দিষ্ট ব্যক্তব্য দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রাজস্ব সংশ্লিষ্ট আইনগুলো অনেকদিন ধরে হয়ে আছে। কিন্তু এগুলো আমরা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারছি না।

বাজেট বাস্তবায়নের হার নিয়েও কিছুটা সমালোচনা করে তিনি বলেন, প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ছে। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবায়নের হার কমছে। ২০১৪ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল ৮১.৮০ শতাংশ, যা কমে ২০১৭ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৭৫.৩০ শতাংশ। তিনি বলেন, ১৯৯৯ সালের পর ২০১৭-১৮ সালে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট প্রথমবারের মতো ঋণাত্মক হয়ে গেছে।

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version