এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : তেইশ বছরের টগবগে তরুণী। দুই চোখে মানবসেবার স্বপ্ন। ক’দিন পরই মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করে বের হওয়ার কথা ছিল চিকিৎসক হিসেবে। কিন্তু ঘাতক বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে শেষ হয়ে গেছে আফসানা ইলিয়াস ইতি আর তার মা-বাবার স্বপ্ন। গত ১৯শে জানুয়ারি ঢাকার রাজপথে বাস চাপায় মারা যান এ হবু চিকিৎসক। সেদিনের ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী মিরাজুল ইসলাম, কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ইতির ঘাতক বাস তুরাগে চড়েছিলেন তিনিও। দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে গেলেও খুব কাছ থেকে দেখেন মানুষখেকো সড়ক ও যানের নিষ্ঠুরতা।
ওই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে মালিবাগ রেলগেট বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষায় ছিলেন মিরাজ।
মালিবাগ থেকে যাত্রাবাড়ীগামী প্রতিটি বাসই ছিল মানুষে ঠাসা। দাঁড়িয়ে থাকা অনেক যাত্রীর মাঝে গায়ে অ্যাপ্রন, কাঁধে ব্যাগ আর মাথায় হিজাব পরা এক মেয়েকে খেয়াল করেন তিনি। ছয়টা ৪০ মিনিটের দিকে রামপুরা থেকে আসা তুরাগ পরিবহনের একটি বাস রেলগেট মোড়ে থামে। বাসটিতেও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। যার যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বাসে উঠতে পাল্লা দেন ৭-৮ জন যাত্রী। ভেতরের কয়েকজন যাত্রী নামতে গেলেই শুরু হয় হুড়োহুড়ি। ঠিক এমন সময় বাসটিকে পাশে নিতে দ্রুতগতিতে টান দেন চালক। মোড়ের সামনে এগিয়ে ৯০ ডিগ্রি টার্ন নেন। গতি আর মোড় ঘোরানোর কারণে খেই হারিয়ে ফেলেন অনেকে। বাস থেকে রাস্তায় পড়ে যান সাদা অ্যাপ্রন পরা মেয়েটি। গতিতে থাকা বাস না থামায় মেয়েটির কোমরের ওপর দিয়ে চলে যায় পেছনের চাকা।
মুহূর্তেই থেমে যায় গাড়ির চাকা, থেমে যায় মেয়েটির জীবনও। বাসের যাত্রীরা দ্রুতই বাসটিকে ঠেলে সরিয়ে আনেন তাকে। মারাত্মক আহত অবস্থায় রিকশায় করে নেয়া হয় খিদমাহ হাসপাতালে। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আর সবশেষে নিজের আঙ্গিনা আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে আনুমানিক রাত আটটার দিকে দেড় ঘণ্টার জীবনযুদ্ধ শেষে হার মানেন ইতি। হাসপাতালে নামে শোকের ছায়া। নিহত আফসানা ইলিয়াস ইতির বড় বোন আফরোজা ইলিয়াস মিতুও পেশায় একজন চিকিৎসক। কাজ করছেন ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বড় বোনের মত ইতিও চিকিৎসক হবার বাসনা নিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হন। নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হবার ইচ্ছা ছিল তার। ঘাতক বাসের চাপার পিষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয় একজন সম্ভাবনাময় চিকিৎসকের। পরিবারের সদস্যদের বাইরেও দেশের মানুষের দুঃখে-অসুখে পাশে থাকবার কথা ছিল তার।
সেই ইতিকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর হাজীগঞ্জের বলখোলা গ্রামের বাড়িতে। ইতি ও মিতুকে নিয়ে ছিল তাদের বাবা-মায়ের সাধ-আহ্লাদ। দুই মেয়েই চিকিৎসক হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, মানুষের পাশে থাকবে এমন স্বপ্ন ছিল ইলিয়াস-আনোয়ারা দম্পতির। ঢাকার মানিকনগর পুকুরপাড় এলাকায় ইতিদের বাড়িটি ছিল দুই বোনের উচ্ছলতায় ভরপুর। সে বাড়িটি এখন শোকে নিথর, স্তব্ধ। ঘটনার আগের দিন ১৮ই জানুয়ারি রাতে পরদিন কলেজে যেতে বারণ করেছিলেন বাবা ইলিয়াস মিয়া। সহপাঠী ফয়সাল আহমেদ জানান, পড়াশোনায় নিয়মিত আর মনোযোগী ইতি বাবার বারণ সত্ত্বেও সেদিন কলেজে যান। পরদিন সার্জারি পরীক্ষা থাকায় ক্লাস শেষে সাড়ে পাঁচটার দিকেই কলেজ থেকে বেরিয়ে যান ইতি। অন্য দিন সব সময় তার সঙ্গে থাকতেন ফয়সাল। কিন্তু সেদিন ফয়সালকে কিছু না বলেই বাসার উদ্দেশ্যে কলেজ থেকে বেরিয়ে যান। রমজান পরিবহনের বাসে যান মালিবাগ পর্যন্ত।
পথেই ছয়টা ১২ মিনিটের দিকে ফেসবুকে কথা বলেন ফয়সালের সঙ্গে। এর ঠিক মিনিট বিশেক পরেই ঘটে দুর্ঘটনাটি। বন্ধুকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে চোখ ছল ছল হয়ে ওঠে সহপাঠী ফয়সালের। প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে তিনদিন পরও স্বাভাবিক হতে পারেননি ইতির কাছের বন্ধুরা। ইতির আরেক সহপাঠী ওমর খৈয়াম জানান, আর নয় মাস পরই চূড়ান্ত পর্বের প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষে ডাক্তার হয়ে যেতেন ইতি। আজ তা কেবলই স্মৃতি। ইতির খালাতো ভাই সায়মন মজুমদার এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না ইতি আর নেই। বোনের পুরনো দিনের খুনসুটি আর হবু চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মুহূর্তগুলো এখনো চোখের সামনেই জ্বলজ্বল করছে। সহপাঠী ফয়সাল বলেন, দুর্ঘটনায় কোমর থেকে শরীরের নিচের অংশের হাড়গুলো টুকরো টুকরো হয়ে যায় ইতির। ক্ষতিগ্রস্ত হয় লিভার, কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। খিদমাহ হাসপাতালে নিয়ে গেলে শুধু পানি খেতে চেয়েছিলেন ইতি। হাইপোভলেমিক শকের কারণে এমনটা হয়ে থাকে।
তবে, শুরুতেই খিদমাহ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া গেলে হয়তো ইতিকে বাঁচানো যেত বলে দাবি করেন এই মেডিকেল শিক্ষার্থী। দেশে বিচারের সংস্কৃতি নেই বলে মেয়েকে হারানোর ঘটনায় জড়িতদের কোনো ধরনের শাস্তি চান না ইতির বাবা-মা। মেয়ের সহপাঠীদের এসব বিষয়ে শান্ত থাকতে বলেছেন তারা। কোনো ধরনের মানববন্ধন-প্রতিবাদে এদেশে কিছুই হয় না বলেও ক্ষোভ ইতির পরিবারের। এ কারণে, কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলেননি তারা। দুর্ঘটনায় ইতি নিহত হবার তিন দিন পর এখনো কোনো মামলা করেনি ইতির পরিবার। মামলা কিংবা আইনি প্রক্রিয়ায় গিয়ে শুধু হয়রানি ছাড়া কিছুই হয় না বলেও ক্ষোভ তাদের। ইতির বাবা সহপাঠীদের বলেছেন, তুরাগ বাসের ঘাতক চালকই হয়তো ক’দিন পরে আরেক বাসে অন্য কারো প্রাণ কেড়ে নেবেন। তাই অনেকটা অভিমানেই মেয়ে হত্যার বিচার চান না বাবা ইলিয়াস মিয়া। সড়কে যাত্রী, চালক আর প্রশাসনের সবার শুভবুদ্ধির উদয় চান তারা।
এদিকে, গত বছরের ২৯শে জুলাই রাজধানীর রেডিসন ব্লু হোটেলের সামনে জাবালে নূর পরিবহনের একট বাস চাপায় মারা যায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম ও দিয়া খানম মিম। নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তায় কিশোর-কিশোরীদের স্লোগানে প্রকম্পিত হয় ঢাকার রাজপথ। শিক্ষার্থীদের হাত ধরে কেবল ৯ দিনে নিরাপদ সড়কের দাবিকে জাতীয় ইস্যুতে রূপ দেন শিক্ষার্থীরা। মূলত আগস্টের প্রথম দিন থেকে নয় দফা দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে অবস্থান নিয়ে যানবাহনের লাইসেন্স পরখ করার পাশাপাশি পথচারীদের আইন মানতে বাধ্য করে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি জানায় নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলোও।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ৯ দফা দাবি মানার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। পাস হয় নতুন সড়ক পরিবহন আইন। নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে সপ্তাহব্যাপী ট্রাফিক সচেতনতা কার্যক্রম চালায় ডিএমপি। আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের কঠোর হাতে দমনে ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। তবে এতকিছুর পরও মোটরসাইকেলের পেছনের আরোহীর হেলমেট নিশ্চিত করা আর বিআরটিএ অফিসে লাইন্সেসের জন্য আবেদনকারীদের ভিড় বেড়েছে শুধু। সচেতনতা বাড়েনি নাগরিকদের মধ্যে। সড়ক রয়ে গেছে তার পুরনো নিয়মেই।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ জানান, বিগত এক দশকের মধ্যে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গত বছর সারা দেশে অন্তত ৩ হাজার ৫১২টি দুর্ঘটনা ঘটে, যাতে প্রাণ যায় ৪ হাজার ৭৬ জনের। সংস্থাটির গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৯১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬৭২ জন, ২০১৬ সালে ১ হাজার ৩৩০টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৯৩১ জন, ২০১৫ সালে ১ হাজার ৬৯০টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭২৫ জন, ২০১৪ সালে ১ হাজার ৫৮৯টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৬৩২ জন, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৭৫৫টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৭৮২ জন, ২০১২ সালে ১ হাজার ৯৩৯টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৯৫৩ জন, ২০১১ সালে ২০১৭টি দুর্ঘটনায় ২০৭২ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ৪৩৭টি দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৪৪৩ জন এবং ২০০৯ সালে ২ হাজার ৮১৫টি পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৭০৩ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সেই হিসাবে গত এক দশকে সারা বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৩ হাজার ৯৮৯ জন মানুষ মারা গেছেন। অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় এমন তথ্য যাওয়া গেছে।
সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় খুব একটা সাজা হওয়ারও রেওয়াজ নেই বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাওমান স্মিতা। তিনি বলেছেন, আইনে মারপ্যাঁচ থাকা, সঠিক সময়ে সাক্ষী হাজির না করাসহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সড়ক দুর্ঘটনার মামলাগুলোয় সাজা নিশ্চিত করা যায় না। যে কারণে বছরের পর বছর মামলা ঝুলতে থাকে। মামলার দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ হয়ে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার পরিবার। আইনের কঠোর বাস্তবায়ন আর নাগরিকদের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন রাওমান স্মিতা।