মো: ইখতিয়ার উদ্দিন রিবা : ঔপনিবেশিক যুগের দখল, প্রত্যক্ষ শাসন ও শোষণনীতির পরিবর্তিত রূপ হলো স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলোকে পরোক্ষ শোষণের কূটকৌশলী নীতি। সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর কাউকে না কাউকে কেন্দ্র করে বিশেষত এশিয়া ও আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলোকে ঘুরপাক খাওয়াই হলো বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কিছু ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রাশিয়া তার মূল ভূখণ্ডীয় সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণে প্রতিবেশী আরো ১৪টি রাজ্যকে ক্রমান্বয়ে অঙ্গীভূত করে বিশ্বে সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এর পরও ১৯৫৬ সালে পূর্ব-ইউরোপের হাঙ্গেরি এবং ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সামরিক অভিযান চালিয়ে উদার মতাবলম্বীদের নিমর্মভাবে দমন করে দেশ দু’টিকে সমাজতান্ত্রিক তাঁবেদারি রাষ্ট্রে পরিণত করে। একই উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে শুরু করা তার অভিযান পরিণামে ব্যর্থ হয়। আর সমাজতন্ত্রের অবসানে ইউনিয়নভুক্ত ১৫টির বেশ কয়েকটি রাজ্য ১৯৯১ সালে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ভোগ করতে শুরু করে।

মূল ১৩টি রাজ্য নিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার আমেরিকা পরবর্তী সময়ে সংলগ্ন রাজ্যগুলোর কিছু দখল ও কিছু ক্রয়ের মাধ্যমে বর্তমানে ৫০টি রাজ্যের গঠিত আমেরিকা বিশ্বে চতুর্থ বৃহৎ রাষ্ট্র। রাশিয়ার কাছ থেকে ১৮৬৭ সালে ক্রয় করা বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের আলাস্কা ১৯৫৯ সালে এর ৪৯তম এবং ১৮৯৪ সালে বিদ্রোহের মদদে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ও নৌঘাঁটি স্থাপন করা হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ ওই একই বছরে ৫০তম ইউনিয়নভুক্ত করা হয়।

বৈরী বা স্বার্থরক্ষায় অনীহার সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাশিয়া এবং একইভাবে না হলেও নির্বাচনে বিরোধী দলকে আমেরিকা বিপুল অর্থ দিয়ে বিজয়ী করে সরকার পরিবর্তনের নজিরও এরা উভয়ই কম রাখেনি। গোপনীয় তথ্য জানার জন্য মাসিক ভাতার বিনিময়ে সরকারের মধ্যেই প্রয়োজনে এরা গোপন এজেন্ট নিয়োগ করে থাকে। এমন অনেক তথ্যসংবলিত সতীশ কুমারের ‘সিআইএ অ্যান্ড দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড’ বইটির ১৭২-৭৩ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে বিস্ময়কর এক তথ্য। একবার দলীয় সভাপতি থাকায় ইন্দিরা গান্ধীসহ কংগ্রেসকে দু’বার দিল্লির আমেরিকান দূতাবাস নির্বাচনে অর্থ দেয় কেরালা ও পশ্চিম বাংলায় বামপন্থীদের বিজয়ের কারণে। নরেশ কুমার জৈনের ‘মুসলিম ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ১০৮ পৃষ্ঠার ১ নম্বর ফুটনোটে করাচির উর্র্দু সাপ্তাহিক ‘আল ফাতেহ’-এর উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘আইয়ুব খানকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকা মাসে ৭০ হাজার ডলার দিত।’

বহু তথ্যের নিরিখে এমনটা প্রশ্নাতীত বলে মনে না হলেও আমেরিকার এসব কর্মকাণ্ডে অনেকেই আজকাল গণতন্ত্রকে ‘ডলার ডিমোক্র্যাসি’ বলে থাকেন। উপনিবেশ থেকে মুক্ত করতে ১৮৯৮ সালে স্পেনের সাথে যুদ্ধ করে ১৯০২ সালে কিউবাকে স্বাধীন করিয়ে নৌঘাঁটি স্থাপন করে আমেরিকা। পরবর্তীকালে সেখানে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠায় আমেরিকার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যন্ত ছিন্ন হয়। কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উসকানি ও সামরিক হস্তক্ষেপে ১৯০৩ সালে পানামাকে স্বাধীন করে পানামা প্রণালী খনন করে আমেরিকা তার স্বীয় স্বার্থ বাস্তবায়ন করে। কিন্তু ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামও ভারতের ভূমিকা আমেরিকার কাছে ছিল অসমর্থিত।

রোয়েদাদ খানের সঙ্কলিত ‘দ্য অ্যামেরিকান পেপারস’ নামের বইয়ের ৫০৫ থেকে ৫১৭ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে এ প্রাসঙ্গিক এক নাতিদীর্ঘ প্রতিবেদন, যা তৎকালীন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ জে সিসকো ১৯৭১-এর ২ মার্চ পাঠান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে। এর সারসংক্ষিপ্ত বক্তব্য হলো- ‘বিভাজ্য দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের চেয়ে যুক্ত পাকিস্তানে আমেরিকার স্বার্থ অধিকতর রক্ষিত হবে। অদূর ভবিষ্যতে জনসংখ্যার চাপে পূর্ব-পাকিস্তান অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়বে।’ এ ছাড়াও তার কথায়, ‘An independent East Pakistan would be more vulnerable to internal instability, economic stagnation and external subversion than an east Pakistan affiliated with west Pakistan.’ অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত থাকার চেয়ে একটি স্বাধীন পূর্ব-পাকিস্তান অধিকতর পরিমাণে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক নিশ্চলতা এবং বাইরে থেকে বিনাশের যোগ্য হবে। কিন্তু এর আদৌ কোনো প্রতিফলন অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের বিচার্য বিষয়।

তবে ১৯৭১-এ পশ্চিম পাকিস্তানকে সমূলে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছে আমেরিকা, যাতে রাশিয়ারও সমর্থন হলো এক নির্ভেজাল সত্য। লন্ডনের কিং কলেজের রিসার্চ ফেলো শ্রীনাথ রাগাভানের ‘ ১৯৭১, অ্যা গ্লোবাল হিস্ট্রি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’ বইয়ের ২৫৪, ২৫৭ ও ২৬২ পৃষ্ঠা মতে, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ যাত্রার সঙ্কেত পায়। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতকে রাশিয়ার মাধ্যমে থামানোর চেষ্টা চালায় আমেরিকা। শেষ পর্যন্ত ১৪ ডিসেম্বর রাশিয়া প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো ভূখণ্ড বিশেষত পাকিস্তানের দখলে থাকা কাশ্মির ইন্দিরা গান্ধীর দখলে না নেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া হয়।

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণের পরদিন ১৭ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে ভারতের একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণার কারণই হলো আমেরিকার ওই নৌবহর পাঠানো, যা আমাদের আদৌ কোনো সম্পর্কিত বিষয় ছিল না। তাই হেনরি কিসিঞ্জার এর পরে নিক্সনকে বলেন, ‘কনগ্র্যাচুলেশনস, মি. প্রেসিডেন্ট, ইউ হেভ সেইভড ওয়েস্ট পাকিস্তান’?

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version