এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : মাত্র ২৫ ডলারের বিনিময়ে যে কেউই নিউজিল্যান্ডে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়ার আশা করতে পারেন এবং পেতে পারেন এমন অস্ত্রের লাইসেন্স। এজন্য তাদের যা করতে হবে তা হলো বিমানবন্দরে পুলিশকে শুধু ডকুমেন্ট দেখাতে হবে যে, তার নিজের দেশে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স আছে। ব্যস, এটুকুই। আর কোনো চেক বা তল্লাশি হবে না। কাগজপত্রের যে বিষয়আশয় তা মুখরক্ষার জন্য করা হয়ে থাকে, যা সহজেই জালিয়াতি করা যেতে পারে।
একজন মানুষ কেন আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে চান সে বিষয়ে আর কোনোই চেক হবে না। যদি তারা চান যে সাউথ আইল্যান্ডে বন্য ছাগল শিকারে যাবেন, ব্যস তাই সই।

নিউজিল্যান্ডে পর্যটকদের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বৈধ থাকে ১২ মাস বা এক বছরের জন্য।

এমন লাইসেন্স পাওয়ার পর তারা এ সংক্রান্ত দোকানে বা অনলাইনে যেতে পারেন। কিনে নিতে পারেন এআর-১৫ এর মতো মিলিটারি স্টাইল সেমি অটোমেটিক (এমএসএসএ) রাইফেল। বিশ্বজুড়ে স্যান্ডি হুকে স্কুলে গুলি, লাস ভেগাস, সান বারনাদিনোসহ বিভিন্ন স্থানের মতো গণহত্যায় এসব অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে।
আর এখন তা হচ্ছে নিউজিল্যান্ডে।

দু’বছরেরও কম সময়ে সিলেক্ট কমিটির এক শুনানিতে সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার নিক পেরি এমপিদের বলেছিলেন, তারা ২৫ ডলার দিয়েই পেয়ে যাচ্ছে একটি লাইসেন্স। ফলে আমি একটি দৃশ্য কল্পনা করতে পারি, যেখানে উদাহরণ হিসেবে আইসিস ইউরোপে তাদের শক্তি ক্ষয়ে ফেলেছে। এখন তারা দুর্বল টার্গেট খুঁজছে। তারা যদি সামান্য বেশি চিন্তাভাবনা করতো তাহলে তারা সহজেই নিউজিল্যান্ডে আসার সহজ পথ পেয়ে যেত। কীভাবে এখানে সহজেই আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার পথ পেয়ে যেত। উচ্চ সক্ষমতার অ্যাসল্ট রাইফেল কেনা সহজ এখানে তারা সেই পথও যদি জানতো তাহলে এখানে আসার পথ পেয়ে যেত।

পর্যটকদের অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়টিতে যে ফাঁকফোকর আছে তা পুলিশ এসোসিয়েশনে একজন উপদেষ্টা হিসেবে বক্তব্যে জোরালোভাবে তুলে ধরেছিলেন নিক পেরি। এটাই অনেক উদাহরণের মধ্যে একটি। যাতে দেখানো হয়েছে ভয়ঙ্কর ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডে অস্ত্র পাওয়া কত সহজ।

একজন মানুষ কি পরিমাণ গুলি বা এ সংক্রান্ত সরঞ্জাম কিনতে পারবেন সে বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। কোন লাইসেন্সধারীর কাছে কি রকম আগ্নেয়াস্ত্র আছে তারও নেই কোনো জাতীয় রেজিস্টার।

এমপিদের এআর-১৫ এর মতো এমএসএসএ আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে নিক পেরি জানিয়েছিলেন। ২০০০ ডলার হলেই এই অস্ত্রটি কেনা যায়। যাদের কাছে এ-ক্যাটাগরির লাইসেন্স আছে তাদের কাছে এআর-১৫ বিক্রি করা হয় শুধু একটি মাগ্যাজিনসহ, যার ভেতর সাতটির বেশি গুলি ধরে না। ১৬ বছর বয়সী একজন মানুষ এই এ-ক্যাটাগরির অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে পারেন।

আপনি যদি উচ্চ সক্ষমতা সম্পন্ন একটি ম্যাগাজিনসহ এমএসএসএ কিনতে চান তাহলে প্রয়োজন হবে ই-ক্যাটাগরির অস্ত্রের লাইসেন্স। এই লাইসেন্সটি পাওয়া অনেকটা কঠিন। তবুও এমপিদের নিক পেরি বলেছিলেন, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাগাজিন অনলাইনে কিনতে পারেন যেকেউ, তাতে তার আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স থাকুক বা না থাকুক।
কোনো কোনো ম্যাগাজিন ধারণ করতে পারে ১৫, ২০, ৩০, ৭৫ এমনকি ১০০ রাউন্ড গুলি। এমনকি এআর-১৫ আগ্নেয়াস্ত্রে ধারণ করতে পারে এমন স্লটও পাওয়া যেতে পারে। সংসদ সদস্যরা ধরে নিলেন ই-ক্যাটাগরির লাইসেন্স ছাড়া কেউ যদি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাগাজিন এআর-১৫ তে ব্যবহার করে তাহলে তা হবে অপরাধ। কিন্তু ততক্ষণে এতে অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবে।

ক্রাইস্টচার্চে গুলি করে ৪৯ জন মানুষকে হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী জাসিনদা আরডেন জরুরিভিত্তিতে অস্ত্র আইন সংস্কারের কথা বলেছেন। তিনি তথ্য প্রকাশ করেছেন যে, অভিযুক্ত হামলাকারী ব্রেনটন টেরান্ট ২০১৭ সালে এ-ক্যাটাগরির লাইসেন্স পেয়েছে এবং পরে আইনসম্মতভাবেই অস্ত্র কিনেছে। এ বিষয়ে জাসিনদা আরডেন বলেন, যখনই নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা শুনতে পারেন যে এই ব্যক্তি বৈধভাবে এসব অস্ত্র অর্জন করেছে এবং ওই হামলা চালিয়েছে, তখন আমাদের অস্ত্র আইন নিয়ে অসংখ্য প্রশ্নের সৃষ্টি হবে। এ জন্যই আমরা দ্রুততার সঙ্গে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবো।

তার মন্তব্য দ্রুততার সঙ্গে লুফে নিয়েছে পুলিশ এসোসিয়েশন। তারা বলেছে, উগ্রবাদীদের অস্ত্র বিষয়ক কোনো তদবিরের কোনো স্থান থাকবে না আসন্ন বিতর্কে।

পুলিশ এসোসিয়েশনের সভাপতি ক্রিস কাহিল বলেছেন, তিক্ত সত্য হলো, ক্রাইস্টচার্চের এই অভিযুক্ত হামলাকারী তার নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় এই অস্ত্র কিনতে পারতো না। ১৯৯৬ সালে পোর্ট আর্থুরে গণহত্যার পর পরই তখনকার প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপ নেন আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেন। তার সঙ্গে ছিল অস্ট্রেলিয়া।

তাসমেনিয়াতে দুটি এমএসএসএ আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে মার্টিন ব্রায়ান্ট হত্যা করেছিল ৩৫ জনকে। ক্ষমতায় আসার দু’এক মাসের মধ্যে দ্রুততার সঙ্গে নতুন একটি আইন সামনে ঠেলে দিলেন। এই আইনে স্বয়ংক্রিয় ও আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে একটি বৃহত্তর জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ক রেজিস্ট্রেশন প্রতিষ্ঠিত করেন। যারা অনিবন্ধিত অস্ত্র সমর্পণ করবে তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমতার একটি সময়সীমা ঘোষণা করবেন।

ওদিকে ‘বাই-ব্যাক’ স্কিমের অধীনে অস্ট্রেলিয়া সরকার ৭ লাখ আগ্নেয়াস্ত্র কেনে। অস্ট্রেলিয়ায় অস্ত্র আইন সংশোধনের উদ্যোগ এখনো বিতর্কিত। এ উদ্যোগের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে ক্ষুব্ধ জনতার সামনে বক্তব্য রাখার সময় হাওয়ার্ড পরেছিলেন একটি বুলেটপ্রুফ ভেস্ট।

যা-ই হোক, নতুন আইনটি পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে হাওয়ার্ডের লিগেসি রয়েই গেছে।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিনদা আরডেন নিশ্চিত করেছেন যে, আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিষিদ্ধ করা হবে অথবা ‘বাই-ব্যাক’ পরিকল্পনা আছে তার আলোচনার টেবিলে। তবে অস্ট্রেলিয়ার মতো, এমন সংস্কারের উদ্যোগ নিউজিল্যান্ডের অস্ত্র বিষয়ক লবি থেকে তীব্র বাধার সম্মুখীন হবে। অতি সম্প্রতি, যেসব অপরাধী তাদের হাতে অস্ত্র পেয়েছে তারা নিক পেরি যে শুনানিতে বক্তব্য রেখেছিলেন, সেই ২০১৭ সালের সিলেক্ট কমিটির আইনশৃঙ্খলার আওতায় আসবেন। ওই সময়কার জাতীয় সরকার ২০টি সুপারিশের বেশির ভাগই অবজ্ঞা করেছিল। কারণ, তখন নির্বাচন ছিল সামনে। আর এই অস্ত্র বিষয়ক লবিং গ্রুপগুলোর ছিল কড়া বিরোধিতা।

কিন্তু ১৯৯০ সালে আরামোয়ানাতে গণহত্যা চালানোর পর থেকে নিউজিল্যান্ডে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র একটি বড় ইস্যু হয়ে আছে। ওই হামলায় দুটি এমএসএসএ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে ডেভিড গ্রে হত্যা করেছিল ১৩ জনকে।
দেশে কি পরিমাণ অস্ত্র আছে তার প্রকৃত কোনো সংখ্যা বা ধারণা নেই পুলিশের। কারণ, ১৯৮২ সালে আগ্নেয়াস্ত্র বিষয়ক রেকর্ড রাখার বিষয়টিকে পরিত্যাগ করা হয়েছে। যাহোক স্যার থমাস থর্প ১৯৯৭ সালে একটি পর্যালোচনা দেন। তাতে প্রমাণ মেলে যে, অপরাধী কর্মকাণ্ডের উদ্দেশে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে। এ সংখ্যা হতে পারে ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার। অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারক বেশ কিছু সুপারিশ হাজির করলেন।

তাতে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কড়াকড়ি বিষয়ক প্রচুর পরিবর্তনের কথা বলা হলো। কিন্তু এর বেশির ভাগই অবজ্ঞা করা হলো। এসব সুপারিশের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো, বিষয়টি পোর্ট আর্থুরে হামলার পর অস্ট্রেলিয়া যে পদক্ষেপ নিয়েছিল সেটার মতো। অর্থাৎ এমএসএসএ অস্ত্র, যেমন এআর-১৫ নিষিদ্ধ করতে হবে। এমন আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে হবে ‘বাই ব্যাক’ স্কিমের মাধ্যমে।

থর্প রিপোর্টের প্রায় ২০ বছর পর নিউজিল্যান্ডকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা অস্ট্রেলিয়ার দেখানো পথে হাঁটবে কিনা। আরডেন বলেন, আমি আপনাদের একটি বিষয় নিশ্চিত করছি যে আমাদের অস্ত্র আইন পরিবর্তন হবে।
(জারেড স্যাভেজ নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড পত্রিকার ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার। তার এ লেখাটি নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডে প্রকাশিত হয়েছে)

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version