মোবাশ্বার হাসান : শ্রীলঙ্কার হামলার পেছনে কিছু মুসলিম সন্ত্রাসীর জড়িত থাকার খবরে খুব অবাক হয়নি ওয়াকিবহাল মহল। হামলার লক্ষ্য, প্যাটার্ন ইত্যাদি বলেই দিচ্ছিল এর পেছনে মুসলিম সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার কথা। কারণ, সমসাময়িক বিভিন্ন গির্জায় হামলার পেছনে বেশির ভাগ সময়ই জড়িত ছিল কোনো না–কোনো মুসলিম সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। নিউইয়র্ক টাইমস-এর খবরে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে, আত্মঘাতী হামলাকারীদের কেউ কেউ সম্প্রতি সিরিয়াতে ভ্রমণ করে থাকলেও এই কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে তারা এই সন্ত্রাসের ট্রেনিং সিরিয়াতেই পেয়েছে। অন্যদিকে আইএস এর দায় স্বীকার করেছে।

শ্রীলঙ্কার কোনো কোনো রাজনীতিবিদ বলছেন, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলার প্রতিশোধ। যদিও নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তা নাকচ করে দিয়েছেন। বলেছেন, তাঁদের গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে সে রকম কোনো তথ্য নেই—এই কথা গুরুত্বের সঙ্গেই নেওয়া উচিত। কারণ, উইকিলিকসের তথ্য অনুযায়ী, সন্ত্রাস দমনে নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দা বাহিনী দক্ষিণ এশিয়ায় খুবই তৎপর। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের যে সমন্বিত গোয়েন্দা কার্যক্রম, যা ফাইভ আই নামে পরিচিত—নিউজিল্যান্ড অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
এ ছাড়া ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ১৫ মার্চ ২০১৯-এর ক্রাইস্টচার্চে মসজিদের হামলা এবং ২১ এপ্রিল ২০১৯-এর শ্রীলঙ্কার হামলার এই স্বল্প সময়ের ব্যবধান বিবেচনায় নিয়ে শ্রীলঙ্কা সন্ত্রাসের পরিকল্পনা, লক্ষ্য ও ব্যাপকতার বিশ্লেষণে বলা যায়, শ্রীলঙ্কার হামলা হয়তোবা কয়েক বছরের পরিকল্পনার ফসল। শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান সারাথ ফনেস্কা—যিনি বর্তমানে প্রাদেশিক উন্নয়নমন্ত্রী—এই হামলার পরে সংসদে বলেছেন, এই ধরনের হামলা পরিকল্পনা করতে নিদেনপক্ষে সাত-আট বছর লাগে।

কিন্তু কেন কিছু শ্রীলঙ্কান মুসলিম নাগরিক নির্বিচারে নিরীহ-নিরস্ত্র নাগরিকের বিরুদ্ধে গণহত্যায় মেতে উঠবে? এই কথা বুঝতে আমাদের যেতে হবে শ্রীলঙ্কার জাতিগত হিংসা, অসহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের গল্পে।

শ্রীলঙ্কায় অসহিষ্ণুতা, জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাস নিয়ে আমার গবেষণার শুরু গত বছর। তখন টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের অনুরোধে আমি দক্ষিণ এশিয়ায় অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে একটি গবেষণামূলক বইয়ের মূল সম্পাদকের কাজ হাতে নিই। আমার সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন জাপানি একজন প্রফেসর কেনজি আইসজ্যাকি ও ভারতীয় সাংবাদিক সমীর ইয়াসির। আগামী জুলাই মাসেই বইটি একটি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা দিল্লি, লন্ডন ও নিউইয়র্ক থেকে একসঙ্গে প্রকাশ করবে।

ওই গবেষণার সময় আমাদের চোখে ধরা পড়ে শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসবাদের পেছনে রয়েছে প্রধান চারটি কারণ। এইগুলো হচ্ছে: ১. শ্রীলঙ্কার জাতিগত অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসের ইতিহাস; ২. বৌদ্ধ উগ্রবাদীদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে সামাজিক অসহিষ্ণু আচরণ করে যাওয়া, যার ফল হিসেবে কিছু মুসলিম ঝুঁকে পড়েছে জঙ্গিবাদের দিকে; ৩. ইন্টারনেটে হিংসার প্রসার ও তরুণ বেকারত্ব এবং ৪. রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীলতা। চারটি পয়েন্টের ব্যাখ্যায় আসছি।

প্রথমত, শ্রীলঙ্কার জাতিগত অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ২০১২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কার ২১ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ বৌদ্ধধর্মের অনুসারী, ১২ দশমিক ৬ শতাংশ হিন্দুধর্মের অনুসারী, ৭ দশমিক ৬ শতাংশ খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী ও ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হচ্ছে ইসলাম ধর্মের অনুসারী। দেশটির বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বেশির ভাগই সিংহলি জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের অনেকেই তামিল জনগোষ্ঠী। আশির দশকের দিকে যখন শ্রীলঙ্কার তৎকালীন সরকার রাষ্ট্রে বৌদ্ধধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন শুরু করে, তামিলরা, বিশেষ করে ছাত্ররা এর প্রতিবাদ জানায় এবং ছোট ছোট ছাত্রভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলে। তারা তামিলদের জন্য শ্রীলঙ্কায় সশস্ত্র পন্থায় একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নেয় এবং সন্ত্রাসী হামলা চালানো শুরু করে। তাদের হামলায় নিহত হন সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য। এর জবাবে শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ এবং শুরু হয় তামিলদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ। গবেষকদের মতে, তখন শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সদস্যরাই শুধু নন, সাধারণ মানুষ এবং কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষু তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমর্থনে ‘বৌদ্ধধর্ম ও মিলিটারি প্রয়াসের’ একটি সম্মিলন ঘটান। যার মূল কথা ছিল, তামিলবিরোধী এই যুদ্ধ ধর্মীয়ভাবেও ঠিক।

১৯৮৩-২০০৯ সাল পর্যন্ত চলতে থাকা এই গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারায় লাখো মানুষ। কিন্তু গৃহযুদ্ধ শেষে দেশটিতে শান্তি আসার পরে জাতিগত হিংসার টার্গেট হয় মুসলমানরা। আসছি লেখার দ্বিতীয় পয়েন্টে।

বদু বালা সেনা বা বৌদ্ধ পাওয়ার ফোর্স নামের এক উগ্র বৌদ্ধ সংগঠন বলা শুরু করে যে শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধধর্মের মূল শিক্ষা থেকে সরে যাচ্ছে এবং এর মূল কারণ মুসলিমরা, যারা বৌদ্ধ দেশটিকে ইসলামিক করার প্রয়াসে লিপ্ত। একই সঙ্গে এই সংগঠন তামিল খ্রিষ্টানদের প্রতিও চরম হিংসাত্মক। এই ধরনের রাজনীতি বর্তমান শ্রীলঙ্কার সমাজে মোটা দাগে দুই ধরনের প্রভাব ফেলে। প্রথমত, দেশটিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিক আক্রমণ বেড়ে যায়। কোনো কোনো প্রদেশে জোর করে মুসলিম নারীদের মাথার হিজাব খুলে ফেলার সংবাদ এসেছে। ২০১৪ সালে বদু বালা সেনা এক সমাবেশে মুসলিমদের সবকিছু বয়কট করার ডাক দেয়। তখন দেশটির আলুথগামা ও বেড়িয়ালা প্রদেশে মুসলিমদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দোকানে ও বাসাবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় কমপক্ষে তিনজন মুসলিম নিহত হন।

দ্বিতীয়ত, এ ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক আক্রমণের ফলে শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। কেউ চায় ইসলাম যে শান্তির ধর্ম, হিংসার না, ভিন্নধর্মীদের সঙ্গে সহাবস্থানে ইসলামে যে কোনো বাধা নেই, তার প্রচার চালাতে। আবার কেউ কেউ হিংসাত্মক হয়ে পড়ে, তারা মনে করে, এই দেশ তাদের না এবং শ্রীলঙ্কার প্রতি একধরনের ক্ষোভে ফেটে পড়তে থাকে ও আইএসে যোগদান করে। দুই দিকের এই উগ্রবাদিতা বাড়তে থাকে এমন সময়ে, যখন শ্রীলঙ্কায় তরুণ বেকারত্বের হার একটি সমস্যায় দাঁড়িয়েছে এবং একই সঙ্গে দেশটিতে ইন্টারনেটের ব্যবহারও বেড়েছে। এই ব্যাখ্যা আমাকে লেখাটির তৃতীয় পয়েন্টে নিয়ে আসছে।

শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ তরুণ। আর এই তরুণদের ১৯ শতাংশ বেকার। এই বেকারত্বের নানা রকম কারণ থাকলেও আমাদের প্রকাশিতব্য বইটিতে তিনজন তরুণ শ্রীলঙ্কান গবেষক তাঁদের গবেষণাপত্রে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের ধরনের তেমন সংগতি না থাকা একটা বড় সমস্যা। ফলে অনেক তরুণ কাজ করতে আগ্রহবোধ করেন না। একই সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় বেড়েছে ইন্টারনেটের ব্যবহার। এক হিসাবমতে, শ্রীলঙ্কায় ২০০৫ সালে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে তিন লাখের মতো, যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬১ লাখে। জাপানের টোডা পিস ইনস্টিটিউটের এক হিসাবে, বদু বলা সেনা প্রায় ৪৬৫টি ফেসবুক অ্যাকাউন্টকে ব্যবহার করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ উগ্রবাদিতা উসকে দিয়েছিল। অন্যদিকে মুসলিম জঙ্গিবাদ বিস্তারে ইন্টারনেটের ভূমিকা এখন সবারই জানা। কিছু শ্রীলঙ্কান মুসলিম জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে।

সবশেষে আলোচনায় আনতে হয় শ্রীলঙ্কার বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহেকে কেন্দ্র করে চলতে থাকা অস্থিতিশীলতা। এই সন্ত্রাসী হামলার আগে সিরিসেনার অধীনে থাকা সিকিউরিটি কাউন্সিল এ ধরনের হামলার তথ্য পেয়েছিল, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা জানতে পারেননি। রয়টার্সের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দারাও প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে চলমান এই বিভেদে জড়িয়ে পড়েছেন। শ্রীলঙ্কান সাংসদ ও পাবলিক এন্টারপ্রাইজ-সংক্রান্ত মন্ত্রী লক্ষ্মণ কিরিয়েলা সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, সিকিউরিটি কাউন্সিলের কিছু গোয়েন্দা ইচ্ছাকৃতভাবে হামলার পূর্ব তথ্য থাকা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্টের প্রতি আনুগত্যের কারণে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে জানাননি।

পরিশেষে বলতে হয়, শ্রীলঙ্কার এই ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার পেছনের কারণ সহজ-সরল না। জাতিগত হিংসার ইতিহাস, বর্তমানের বদু বলা সেনার উত্থান, তরুণ বেকারত্ব ও ইন্টারনেটে হিংসার প্রসার এবং রাষ্ট্রকাঠামোতে বিরাজমান দ্বন্দ্বের আঙ্গিকে পর্যালোচনা করলে ঘটনার পেছনের ঘটনা সম্পর্কে কিছুটা গভীর বিশ্লেষণ উঠে আশা সম্ভব।

ড. মোবাশ্বার হাসান: নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কর্মরত

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version