শেষ ওভারের নাটক
অধিনায়কের ভার নামিয়েই নায়ক হয়ে গেলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। বীরোচিত, নায়কোচিত নানা বিশেষণেই আখ্যা দিতে পারেন তার ১৮ বলে করা ৪৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংসকে। ইতিহাসে এমন নাটকীয় খেলার নজির যতই থাক গত ১২ মাসে এমন টি-২০ ম্যাচ আর দেখা যায়নি বললে ভুল হবে না। শ্রীলঙ্কার ১৫৯ রানের জবাবে ১৯ ওভারে বাংলাদেশের সংগ্রহ ১৪৮ রান। সাত ব্যাটসম্যান ফিরে গেছেন সাজঘরে। মাহমুদুল্লাহর সঙ্গে যোগ দেন বোলার মোস্তাফিজ।
শেষ ওভারে চাই ১২ রান। বোলার উদানা প্রথম দুই বল মোস্তাফিজুর রহমানের মাথার ওপর দিয়ে পাঠালেন। চেষ্টা করেও ব্যাটে বল ছোঁয়াতে পারলেন না মোস্তাফিজ। কিন্তু আম্পায়াররা নির্বিকার। ডাকলেন না ‘নো বল’। অবশ্য দ্বিতীয় বল ব্রাটে না লাগলেও স্ট্রাইক নেযডার জন্য অপর প্রান্তে চলে যান মাহমুদুল্লাহ। রানআউট হয়ে যান মোস্তাফিজ। এসময় নো বল নিয়ে আপত্তি তোলেন মাহমুদুল্লাহ। খেলা বন্ধ থাকে কয়েক মিনিট।
প্রধান কোচ কোর্টনি ওয়ালশ, খালেদ মাহমুদ সুজন, অধিনায়ক সাকিবসহ অন্য খেলোয়াড়দেরও অনেকে চলে আসেন সীমানার পাশে। তাদের ঠান্ডা করে খেলা শুরু হলে চার বলে দরকার ছিল ১২ রান। মাহমুদুল্লাহ এবার ওয়াইড হতে যাওয়া বল অনেকটা একহাতে মেরে সীমানার বাইরে পাাঠিয়ে দিলেন। নীরব হয়ে গেল গ্যালারি। আশান্বিত হয় বাংলাদেশ। পরের বলে দৌড়ে দুই রান নিলেন মাহমুদুল্লাহ ও রুবেল। দুই বলে চাই আর ৬ রান। সংশয়ে বাংলাদেশের কোটি সমর্থক। বছর দুই আগে ভারতের বিপক্ষে ব্যাঙ্গালুরুতে টি-২০ বিশ্বকাপের খেলায় তিন বলে দুই রান দরকার ছিল বাংলাদেশের। সেবার ব্যর্থ হয়েছিলেন মাহমুদুল্লাহ।
আউট হয়ে গিয়েছিলেন ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে। এবার আর সেই ভুল নয়। এক বল হাতে রেখেই বিশাল এক ছক্কা হাঁকিয়ে জয় নিশ্চিত করেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। দুই উইকেটের জয়ে ফাইনাল নিশ্চিত বাংলাদেশের। আগামীকাল ফাইনালে ভারতকে হারানোর প্রত্যয় সাকিব-মুশফিকদের চোখে মুখে। বাংলাদেশের শ্বাসরুদ্ধকর জয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় পুরো শ্রীলঙ্কা। আর প্রায় গভীর রাতে উল্লাসে ফেটে পড়ে গোটা বাংলাদেশ। অনেক জায়গাতেই মিছিল বের করে ফেলেন তরুণেরা।
নিজেদের স্বাধীনতার ৭০ বছরপূর্তিতে আয়োজিত প্রতিযোগিতা। আর তাতেই ফাইনালে দর্শক বনে গেল স্বাগতিক দল। মাত্র মাস খানেক আগেই বাংলাদেশকে হারের পর হারে জর্জরিত করে দেশে ফিরে যাওয়া লঙ্কানরা এভাবে নিজভূমে এমন হার দেখবে তা কল্পনারও অতিত ছিল দ্বীপবাসীর কাছে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতির বিশেষ উদ্যোগে যেন ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ।
গতকালও তিনি ছিলেন মাঠে। দীর্ঘদিন পরে সাকিব আল হাসানের উপস্থিতিতে নতুনভাবে উজ্জীবিত বাংলাদেশের কাছে হার মানতে হলো শ্রীলঙ্কাকে। পেসার আবু হায়দার রনির পরিবর্তে মাঠে নামেন সাকিব। কলম্বোতে এ রাত যেন এক কালো-রাত্রি হয়ে থাকবে। নিশ্চয়ই সাবেক শিষ্যদের কাছে হারে হতাশ হলেও গর্বও বোধ করতে পারেন মাস ছয়েক আগে বাংলাদেশের চাকুরি ছেড়ে দেয়া কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
প্রথম খেলায় শ্রীলঙ্কাকে বাংলাদেশ হারায় রেকর্ড ২১৪ রান তাড়া করে। তাই ১৬০ রানের লক্ষ্য অসম্ভব মনে করার কারণ ছিল না। সংশয়ও ছিল কম। কিন্তু তামিমের সঙ্গে ওপেন করতে এসে এবার লিটন শূন্য রানে ফিরে গেলে প্রথম ধাক্কা খায় বাংলাদেশ।
এরপর ছয় থেকে নামিয়ে আনা সাব্বির সাবলীল শুরুর পরে ১৩ রানে যখন আউট হন তখন দলের রান মাত্র ৩৩। দুজনই স্পিনার আকিলা ধনঞ্জয়ের শিকার। লিটন ওয়াইড বল মারতে গিয়ে কট আর সাব্বির হাঁকাতে গিয়ে স্টাম্পড। তৃতীয় উইকেটে তামিম আর মুশফিক হাল ধরেন। লঙ্কানদের হতাশা বাড়তে থাকে। এবার দলীয় ৯৭ রানে ২৫ বলে ২৮ রান করে আউট হলেন মুশফিক। তবে ২৫ রানের মাথায় তৃতীয় বাংলাদেশী হিসেবে টি-২০তে হাজার রানের মাইলফলক পেরোন তিনি। ১৩ ওভার শেষে বাংলাদেশ ঠিক ১০০তে। ৪২ বলে চাই ৬০ রান।
হাতে উইকেট সাতটি। কোন ব্যাপারই না অবস্থা। কিন্তু পরের ওভারেই ব্যক্তিগত ৫০ রান পূরণ করে বিদায় নিলেন তামিম গুনাথিলাকার বলে। টি-২০ ক্যরিয়ারের পঞ্চম ফিফটি করেন ৪২ বলে দুই ছক্কা আর চার চারে। দলের রান তখন ১০৫/৪। পাঁচ বল পরেই আউট ১১ বলে ১০ রান সৌম্য সরকার। এরপর মাহমুদুল্লাহ-সাকিব জুটি বেধে এগুতে থাকেন। হঠাৎ খেলতে নামায় নিচের দিকে ব্যাটিংয়ে নামেন সাকিব। কিন্তু তিনিও যখন চলে গেলেন ৯ রান করে তখন শঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করে। ১২ বলে তখন চাই ২৩ রান।
ক্রিজে আসেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ওভারের শেষ বলে রানআউট হলেন তিনি শূন্যরানেই। সেখান থেকেই নাটকের শেষ অঙ্কের শুরু। যার শেষ মাহমুদুল্লাহর ছক্কায়। ১০ বলে ২০ রান করার পর ৮ বলে তিনি করেন ২৩ রান। এতে ছক্কা দুটি আর চার তিনটি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-২০তে এটি বাংলাদেশের চতুর্থ জয়।
বোলাররা বাংলাদেশকে সাহসী করে তুলেছিল। টসে জেতার পরে ফিল্ডিং বেছে নেন সাকিব। আর ৪১ রানে তাদের পাঁচ উইকেট তুলে একপেশে করে ফেলেন বাংলাদেশের বোলাররা। প্রথম উইকেটই নেন সাকিব। এরপর অসাধারণ বল করেন মোস্তাফিজ। শ্রীলঙ্কা ১০০ রান করের ১৫.১ ওভারে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলে ৬০। আর এর পুরো কৃতিত্ব দুই পেরেরার।
কুসাল পেরেরা ৪০ বলে ৬১ আর তিসারা পেরেরা ৩৭ বলে ৫৯ রান করে শ্রীলঙ্কাকে লড়াই করার পুঁজি এনে দেন। ষষ্ঠ উইকেটে দুই পেরেরা ৯৭ রান যোগ করেন যা ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা। আর চার রান করলে ছুঁতে পারতেন তাদের বিপক্ষে ২০১০-এ মাইক হাসি ও ক্যামেরন হোয়াইটের করা ১০১ রানের রেকর্ড। অধিনায়ক থিসারা পেরেরার টি-২০ ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটির আনন্দ অবশ্য শেষতক মাটিই হয়ে যায়।