আবদুস সামাদ আজাদ

দূর থেকে হলের গেটে চোখ চলে যায় নাবিলার। মনটা ফুরফুরে আজ। টানা ৬টি এক্সাম আজ শেষ হয়েছে। জাস্ট এক্সাইটেড মুড।
উহ কি যে আরাম বোধ হচ্ছে মস্তিষ্কে তা কাউকে বোঝানো যাবে না। রুবিনা ও মালিহা নাবিলার দ্ইু বান্ধবি। ওরাতো বাড়ি যাওয়ার টিকিটও কেটে রেখেছে এক সপ্তাহ আগে। পরীক্ষা শেষে বাড়ির দিকে উড়াল দেবে। বিমানে ঠিকই না, তবে ট্রেনে উড়ালের স্বাদ নেয় ওরা। মধ্যবিত্ত জীবন কত সংকটের মধ্য দিয়ে চালাতে হয় তা নাবিলা জানে। এজন্যই তো মাটি ঘেঁষেই উড়াল দিতে হয়। ঝকঝকে শপিংমলে গিয়ে ঘোরা হয় কিন্তু পছন্দের কতগুলো জিনিস রেখে আসতে হয়। কেনা হয় না।
ওপাশে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির গেটে জটলা। হাকিম চত্বরে বহিরাগত লোকেদের আনাগোনা ইদানিং বেড়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবরই এসব বিষয়ে উদাসীন। মূল গেট এড়িয়ে ভাষা ইনস্টিটিউটের পাশ দিয়ে হলে ঢোকার চিন্তা তার। একটা চিন্তা নাবিলার মনে ঝিলিক দিচ্ছে বার বার। বাবাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে হবে। বাবা বলেছিলেন, ক্লাসের পড়ার পাশাপাশি বাইরের বই, বিশেষ করে ইতিহাস বই বেশি করে পড়তে। তাহলে জীবন, জগত সম্পর্কে ধারণা বিস্তারিত হবে।
নাবিলা বাবার কথা মনে রেখেছে। প্রতিদিন পাবলিক লাইব্রেরিতে সময় দিয়েছে। ইতিহাস বিষয়ক নানা বই পড়েছে। বাংলাদেশ-ভারতের ইতিহাস, এশিয়ার ইতিহাস, আফ্রিকা-আমেরিকা-ইউরোপের ইতিহাসে চোখ বুলিয়েছে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বনেতাদের ভূমিকা ভাল করে পড়েছে সে। বাংলাদেশের ইতিহাস তো আছেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিশেষভাবে অধ্যয়ন করেছে নাবিলা, কারণ এতো তার জন্মের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস। সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র সব বিষয় তার জানা। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নাবিলা যেন চে গুয়েভারার বন্ধু। কতদিন চে’র সাথে হেঁটেছে জঙ্গলে, মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে তার হিসেব নেই। তিন শতাধিক বইয়ের লাইব্রেরি তার টেবিল ও লকার ঘিরে। তার পরিকল্পনা, একটা বই প্রকাশ করেই বাবাকে চমকে দেবে সে।
টানা ১১দিন ক্লাস নেই, বিশাল সুযোগ তার সামনে। পুরো ছুটিটাই সে পাণ্ডুলিপিটা ঠিকঠাক করার কাজে লাগাবে। কিন্তু পরীক্ষা শেষে মনটা চাচ্ছে ওয়াকিলকে নিয়ে ঘুরবে কিছুদিন। ছেলেটা কোথায় যে যায়! মাঝে মাঝে তার খোঁজ থাকে না। ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। চরম বিরক্তি এসে যায় ওয়াকিলের প্রতি। মাথা গরম হয়ে ওঠে নাবিলার। জ্বালাতন করলেও সৃজনশীলতার কাজে ছেলেটাকে পাওয়া যায়। তাদের অন্তরঙ্গতার সঙ্গে দেশের ভালবাসা জড়িত, জড়িত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মনে পড়ে যায় সেই বিশ্বনেতার কথা, ৭ মার্চের ভাষণের কথা। নাবিলা বঙ্গবন্ধুর জীবনী থেকে সংগ্রহ করেছে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার মন্ত্র।
বেলা বেড়ে যাচ্ছে। দ্রুত পা চালায় নাবিলা। ওই তো হলের গেট। কিন্তু ওয়াকিলকে এখনও দেখা যাচ্ছে না। অপেক্ষা করে নাবিলা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। পশ্চিম দিকের সড়কে বার বার চোখ চলে যাচ্ছে তার। ওয়াকিল আসবে। পাঁচিলের ওপরে লতার ঝোপে গাড় সবুজ । সেদিকে চোখ চলে যায় নাবিলার। সবুজ রঙ চোখের জ্যোতি বাড়িয়ে দেয় বলে জানে সে। তবে কোথা থেকে জেনেছে সে রেফারেন্স মনে নেই তার। মনে পড়ে যা মায়ের কথা। মা-ই তো বলেছিল কথাটা। সেই নানুদের বাড়িতে গত বছর টানা তিনদিন কাটিয়েছিল তারা। মায়ের কলেজে ক্লাস থাকার কারণে দ্রুত চলে আসতে হয়েছিল। সেদিন ছিল রোববার। নানুদের পুকুরপাড়ে বিকেল বেলাটা মায়ের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা দিয়েছিল তারা। পুকুর পাড়ে ডুমুরের ঝোঁপ। কচি সবুজ পাতারা ঝলক দিচ্ছিল। মা বলেছিল কি সবুজ তাই না? তাকিয়ে থাক চোখের জ্যোতি বাড়বে। মায়ের কথাটা মনে ধরেছিল তার। মায়ের সঙ্গে তার যত গল্প, বন্ধুত্ব সবই দারুণ উপভোগ করে নাবিলা। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত মা-ই ছিল তার অন্তরঙ্গ বন্ধু, এখনও।
ওয়াকিলের সঙ্গে নাবিলার বোঝাপড়াটা দারুণ। ওর কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে যায় নাবিলার। এখনও এল না। মোটরসাইকেলের পিক পিক শব্দে সম্বিত ফিরে পায় নাবিলা। পূর্বদিকে ফিরে তাকায় সে। আমি তো পশ্চিমে তাকাতে তাকাতে হয়রান হয়ে গেছি। তুমি তো উল্টোটাই ভাল করে বোঝ, খোঁচা দেয় ওয়াকিল। নাবিলা চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছে, এবার ও রেগে যাবে ওয়াকিল তা বুঝতে পারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রেসের কথা বলতে শুরু করে সে। কৌশল কাজে লাগে ওয়াকিলের, নাবিলা শান্ত হয়। শেষ বারের মত পাণ্ডুলিপিতে চোখ বুলিয়ে নিতে বলেছেন ইমতিয়াজ স্যার। নাবিলার বুকটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। শেষ পর্যন্ত বইটা বের হচ্ছে। মনে পড়ে বাবার কথা। বাবা কি যে খুশি হবে বইটা হাতে নিয়ে। চাচু বলে দিয়েছেন বইটা বের হলে ১০০ কপি কিনে নেবেন গিফটের জন্য। খুশিতে ভরে উঠেছে তার মুখ।
ওয়াকিলের হাতে পাণ্ডুলিপি, হ্যাচকা টানে তা নিয়ে নেয় নাবিলা। অজান্তেই চোখাচোখি হয়। নাবিলা পাণ্ডুলিপি বুকে টেনে নেয়। পাণ্ডুলিপিটি যেন তার একমাত্র অবলম্বন। নিরুদ্বেগ নাবিলার চোখে আবারও চোখ পড়ে যায় ওয়াকিলের। সেখানে ঝড়ের আভাস। এই মামা.. ধানমমণ্ডি যাবেন? ওরা উঠে পড়ে রিকশায়।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও গল্পকার

Share.

Comments are closed.

Exit mobile version